কয়েক লক্ষ টাকা তো ফস্কে গেল! এই কথার প্রত্যুত্তরে কি বলেছিলেন নেতাজি?

281

আটাত্তর বছর আগেকার কথা, উনিশশো তেতাল্লিশের শেষাশেষি। নেতাজি তখন সিঙ্গাপুরে দিবারাত্র পরিশ্রম করছেন। দিনে চার ঘন্টা নিদ্রা দেন কি দেন না। এমন সময় একদিন সকালে নেতাজি ডিটেকশন দিচ্ছেন, এমন সময় অ্যাডজুটেন্ট এসে বলল ব্রিজলালজি দেখা করতে এসেছেন ওনাকে কি অপেক্ষা করতে বলব ?

ব্রিজলাল জয়সোয়াল হচ্ছেন সিঙ্গাপুরের ধনিকশ্রেষ্ঠ, গুজরাটি চেট্টিয়ার। তিনপুরুষ ধরে বর্মামূলূকে ওনাদের পারিবারিক ব্যবসা। শহরের অন্যতম মাথা তিনি। নেতাজি অ্যাডজুটেন্টকে বললেন ওনাকে ভিতরে নিয়ে আসতে।

ভিতরে এলেন ব্রিজলাল জয়সোয়াল, ভারতীয় পোশাক। সিল্কের চোগা চাপকান। ভিতরে এসে যুক্তকরে নেতাজিকে নমস্কার করলেন। নেতাজিও প্রতিনমস্কার করে ওনাকে বসতে বলে প্রথমেই বললেন সুপ্রভাত জয়সোয়ালজি। আপনি নিজে থেকেই আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন দেখে ভালোই লাগল। এই তো আমি চাই। আপনারা আজাদ হিন্দ ফান্ডে এসে যা দান করবেন তা নিজে থেকে এসেই দান করে যাবেন। আপনি সিঙ্গাপুরের ধনীশ্রেষ্ঠ – আপনিই তো আদর্শ স্হাপন করবেন। দানটা কি আপনি করবেন, না চেট্টিয়ার মন্দির কর্তৃপক্ষ করবে?

ব্রিজলাল জয়সোয়াল প্রত্যুত্তরে বললেন যে দানটা চেট্টিয়ার মন্দির কর্তৃপক্ষ করবে কিন্তু একটা ছোট আবদার আছে আমাদের। আপনি যদি অনুগ্রহ করে ট্যাঙ্ক রোডে আমাদের মন্দিরে পদধূলি দেন তাহলে সেখানেই আমরা চেকটা হস্তান্তরিত করে ধন্য হই।

নেতাজি তৎক্ষণাত বললেন, ভুল বলছেন ব্রিজলালজি। মন্দিরে আমি পদধূলি দেব কেমন করে ? ভক্তদের পদধূলি তো মাথায় তুলে নিতে যাব। আপনি শুনে থাকবেন আমি মাঝেমাঝেই রামকৃষ্ণ মিশনে যাই। কিন্তু সেটা ব্যক্তিগতভাবে – সুভাষ বোস হিসাবে। কিন্তু আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক হিসাবে কোনো ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মন্দিরে যাওয়া তো সম্ভব নয়।

— কেন নয়, নেতাজি? আপনি তো হিন্দু?

— না। ‘সুভাষ বোস’ হিন্দু। ‘নেতাজি’ শুধুমাত্র ভারতীয়।

— তাহলে সুভাষ বোস হিসাবেই আসুন আপনি।

— যাব তবে ফৌজি পোশাকে নয়। আর তখন টাকাটাও নিতে পারব না আমি।

নেতাজির সাফ কথা – না হয় মন্দির কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে পরে আমাকে জানাবেন। আজ আসুন।

মাথা নিচু করে উঠে গিয়েছিলেন ব্রিজলাল জয়সোয়াল।

ব্রিজলাল জয়সোয়াল চলে যাওয়ার পর ফাঁকা দেখে অ্যাডজুটেন্ট নেতাজীকে বলেছিল -এ শর্তে ওরা কিছুতেই রাজী হবে না নেতাজী। তার মানে কয়েক লক্ষ টাকা ফস্কে গেল।

শুনে নেতাজি বলেছিলেন ‘তোমাদের নেতাজির বিবেকের দাম কয়েক লক্ষ টাকার অনেক বেশী।’

পরদিনই আবার ফিরে এলেন ব্রিজলালজি। সঙ্গে মন্দির কমিটির আরো পাঁচ ছজন কর্মকর্তা। ওদের সকলের তরফে ব্রিজলাল জয়সোয়াল বললেন আমরা আপনাদের নিমন্ত্রণ করতে এসেছি নেতাজী। বলুন কবে আপনারা আসবেন?

— আমার মুসলমান আর খ্রিস্টান বন্ধুরাও আমার সঙ্গে যাবে তো?

— নিশ্চয়ই, আমরা বিবেচনা করে দেখেছি নেতাজি । ওরা মায়ের চোখে মুসলমান নন, খ্রিস্টানও নন —ওরা বন্দিনী মায়ের মুক্তিযোদ্ধা। আমরা ফুল দিয়ে অর্ঘ্য দি, ওনারা বুকের রক্ত দিয়ে অর্ঘ্য দেন। ওঁরা আরও বড় জাতের ভক্ত।

নেতাজীর আদর্শে দুশ’বছরের পুরনো সংস্কারকে ছিন্নভিন্ন করে সেদিন সিঙ্গাপুরের চেট্টিয়ার মন্দিরের দ্বার সাধারণ ভারতবাসীর জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছিল।

সিঁড়ির ধাপের পাশে নেতাজি খুলে রাখলেন তার মিলিটারি টপবুট। দেখাদেখি নগ্নপদ হলেন নিষ্ঠাবান খ্রিস্টান আইয়ার, ধার্মিক মুসলমান কিয়ানি আর হবিবুর রহমান। মন্দিরের পুরোহিত প্রত্যেকের কপালে একে দিলেন হোমশিখার জয়তিলক। নেতাজির দেখাদেখি ওরা যুক্ত করে দেবীপ্রণাম করলেন। সমবেত কণ্ঠে ধ্বনি উঠল — হর হর মহাদেও না, আল্লাহু আকবর না — ধ্বনি উঠল জয় হিন্দ।

         – নারায়ণ সান্যাল