জানেন কি? গোপাল ভাঁড়কে সঙ্গে নিয়ে সর্বপ্রথম বাংলায় কালীপুজোর প্রচলন করেছিলেন মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র!

808

মা কালীর পুজো হয় প্রধানত কার্তিক মাসের অমাবস্যা তিথিতে। তবে, কালী ছাড়াও হিন্দু সম্প্রদায়ে এই দেবী শ্যামা ও মহানিশা নামেও পরিচিত। ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ, ওড়িশা, অসম ও বাংলাদেশে এই পুজো প্রচলিত আছে।একই দিনে অন্যান্য হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষদের মধ্যে অলক্ষ্মী-লক্ষ্মী পুজোর প্রচলনও আছে। সংসার থেকে অলক্ষ্মী বিদায় করে এই দিন ধন-সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। এই দিনেই ধনতেরাস উৎসব পালিত হয়। সংসারে লক্ষ্মীর অভ্যর্থনা ও আগমন সূচিত করতে, সোনার গয়না কেনা হয় এই দিনটিতে। এই বিশেষ দিনটি বাঙালীদের কাছে ‘দীপাবলি’ ও অবাঙালীদের কাছে ‘দিওয়ালী’ নামে পরিচিত। এই দিনে ভারতের মিথিলা প্রদেশের মৈথিলী সম্প্রদায় এবং নেপালি সম্প্রদায়ের মানুষেরা মহানিশা পুজোর আয়োজন করে থাকেন ।কালীপুজোর ইতিহাস কি চলুন এবার চটপট জেনে নিন সেকথা-

অনুষ্ঠানটি খুব প্রাচীন নয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর আগে পর্যন্ত কালীপুজো সেভাবে প্রচলিত ছিল না বলেই জানা যায়। তবে সপ্তদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বলরাম রচিত কালিকা-মঙ্গলকাব্যের কথা জানা যায়। সর্বপ্রথম এই পুজোর প্রচলন হয় বাংলায়। নবদ্বীপের রাজা কৃষ্ণচন্দ্র অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম এই পুজোর প্রচলন করেন। কথিত আছে রাজার বিশ্বাসযোগ্য মানুষ গোপাল ভাঁড়ের সাহায্যকে পাশে নিয়েই এই পুজো শুরু হয়। তবে ঊনবিংশ শতাব্দীতে এই পুজো প্রথম জনপ্রিয়তা লাভ করে, রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের নাতি শ্রী ঈশ্বরচন্দ্রের হাত ধরে। অভিজাত সম্প্রদায় ও ধনী জমিদারেরা অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে এই উৎসব পালন করতেন। দুর্গাপূজার মতোই কালিপূজাও বাংলা ও আসামের একটি বড় উৎসব। বাড়িতে প্যান্ডেল করে, সেখানে মৃৎমূর্তী স্থাপন করে মহা ধুমধামের সঙ্গে মা কালীর আরাধনা করা হয়। মন্ত্র উচ্চারণ করে, তান্ত্রিক মতে, রাত্রিবেলায় এই পুজো হয়। তবে মায়ের এই পুজো লাল জবা ফুলের মালা ছাড়া অসম্পূর্ণ। প্রাণীর রক্ত উৎসর্গ না করলে এই পুজো হয় না। এছাড়া চালের নৈবেদ্য , মাছ ও মাংসও কালীপুজোর ভোগ হতে পারে। প্রথা অনুসারে মাকে সূরা উৎসর্গ করা হয়। এই পুজোয় পাঁঠাবলীরও প্রচলন আছে। পূজারী বা পূজারিণীরা রাত থেকে ভোর অবধি মায়ের ধ্যান করতে পারেন। তবে এটি তান্ত্রিক মত। এই মতের বাইরেও পুজো করা যায়। সাধারণ গৃহস্থেরা মাকে বস্ত্র পরিহিতা আদ্যাশক্তি রূপে পুজো করে থাকেন। মনে করা হয় শ্মশানে এই দেবীর অধিষ্ঠান। এই বিশ্বাসে কলকাতা ও অসমের বহু শ্মশান ভূমিতে নিষ্ঠা সহকারে এই পুজো করা হয়।

প্রসঙ্গত, উল্লেখ্য, কার্তিক মাসের অমাবস্যায় অনুষ্ঠিত বার্ষিক কালীপুজো ছাড়াও, প্রতিমাসের অমাবস্যায় এই পুজো হয়ে থাকে। আরো দুটি গুরুত্বপূর্ণ পুজো হলো রটন্তী কালীপুজো, ও ফলহারিণী কালীপুজো। রটন্তী কালীপুজো, মাঘ মাসের কৃষ্ণা চতুর্দশীতে হয়ে থাকে। বঙ্গীয় ক্যালেন্ডার অনুযায়ী জৈষ্ঠ্য মাসের অমাবস্যায় ফলহারিণী কালীপুজো হয়ে থাকে। এই পুজো শ্রী শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণদেব ও তাঁর স্ত্রী সারদা দেবীর কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ১৮৭২ সালে এই দিনটিতে পরমহংসদেব তার স্ত্রী সারদা দেবীর সদাশী রূপের আরাধনা করেছিলেন। আজও বহু বাঙালী ও অসমীয়া পরিবারে মা কালীর নিত্য আরাধনা হয়ে থাকে।

উল্লেখ্য, কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয়া মহিষীর গর্ভজাত একমাত্র শম্ভুচন্দ্রই এখানে অবস্থান করেন এবং তাঁর বংশধররা এখানে বসবাস করতেন। এই শাখা বংশ কৃষ্ণচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ রক্তসম্পর্কিত। শম্ভুচন্দ্রের মধ্যম পুত্র পৃথ্বীচন্দ্রের পত্নী রাধামণিদেবী ১৭৮৫ শকাব্দে ( ১৮৬৩ খ্রীষ্টাব্দে ) পঙ্খের অলংকরণযুক্ত একটি দক্ষিণমুখী চারচালা মন্দির নির্মাণ করে চিন্ময়ী নামে কষ্টিপাথরের এক কালীমূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন। চাকদহ থানার অন্তর্গত সুখসাগর গ্রামে নদিয়ারাজ কৃষ্ণচন্দ্র এক চারচালা মন্দির নির্মাণ করে উগ্রচণ্ডী বা সিদ্ধেশ্বরী নামে পাথরের এক কালী মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন।বহুদিন পূর্বে মন্দিরটি নদীগর্ভে নিমজ্জিত হওয়ার আশঙ্খা হলে মূর্তিটি হরধামের চিন্ময়ী মন্দিরে রাখা হয়। আগেই বলা হয়েছে, হরধামের রাজপ্রাসাদ-মন্দিরও আজ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় । বর্তমানে চিন্ময়ী ও সিদ্ধেশ্বরী কালী মূর্তি নদিয়ারাজ বংশের হরধাম শাখার বংশধর যোগেশচন্দ্র রায়ের ( রানাঘাট, ছোটবাজারের কাছে ) বাসভবনে এক শিখরযুক্ত দালান মন্দিরে একটি কাঠের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিতা ও নিত্যপূজিতা।