ঐশ্বরিক ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও মহাভারতে কেন শ্রীকৃষ্ণ পাশা খেলা বন্ধ করতে পারলেন না? জানুন…

শৈশব থেকেই উদ্ভব শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে থাকতেন; তার রথ চালানো থেকে শুরু করে অনেক সেবা করতেন। কিন্তু তিনি কখনোই ভগবানের কাছ থেকে কোনো সাহায্য বা বর প্রার্থনা করেননি। যখন ভগবান তাঁর শ্রীকৃষ্ণ অবতার লীলার প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌছেছেন, তখন একদিন তিনি উদ্ভবকে বললেন,

“প্রিয় উদ্ভব, আমার এ অবতারে কত মানুষকে আমি সাহায্য করেছি, বর দিয়েছি। কিন্তু তুমি আমার কাছে কখনো কিছু চাও না। তুমি এখনই আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করো; তোমাকেও কিছু কৃপা করার আনন্দ লাভের মাধ্যমে এ অবতারে আমার লীলা সমাপ্ত করতে চাই।”

এরপর উদ্ভব বললেন, “প্রথমে আমায় বলুন, প্রকৃত বন্ধু কে?” তখন শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “প্রকৃত বন্ধু সেই, যে বন্ধুর বিপদে সাহায্যের আহ্বানের অপেক্ষা না করেই বন্ধুর সাহায্যে চলে আসে।” উদ্ভব বললেন, “আপনি তো পান্ডবদের প্রিয় বন্ধু ছিলেন, তারা আপনাকে আপাদবান্ধব (সব বিপদের পরিত্রাতা) বলে বিশ্বাস করত। আপনি তো শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎও জানেন; আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী; আপনি কি তাদের সাথে প্রকৃত বন্ধুর মতো আচরণ করলেন?

আপনি কেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলা থেকে বিরত রাখলেন না? আর যখন তা করলেন না, তবে কেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের পক্ষে ভাগ্যকে পরিচালিত করলেন না যাতে অন্তত ধর্মের জয় হতো। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ধন-সম্পদ, রাজ্য ও নিজেকে হারানোর পর আপনি তো পাশা খেলা বন্ধ করতে পারতেন। পাশা খেলার দন্ড থেকে আপনি তাঁকে রক্ষা করতে পারতেন। আপনি তাও করেননি।

দুর্যোধন যখন প্রস্তাব করেছিল যে, পান্ডবদের সব সৌভাগ্যের উৎস দ্রৌপদীকে পাশার বাজী রাখলে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সব হারানো সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া হবে, আপনি তো তখন আপনার ঐশ্বরিক ক্ষমতা ব্যবহার করে পাশার গুটিকে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের পক্ষে চালিত করতে পারতেন। বরং আপনি তখন এলেন, যখন দ্রৌপদী তার সম্ভ্রম প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন। আর আপনি দাবি করেন যে, আপনি বস্ত্র দিয়ে তার সম্ভ্রম রক্ষা করেছেন?

সভায় এতগুলো মানুষের মধ্যে একজন স্ত্রীলোকের চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে এনে তার পরনের বস্ত্র প্রায় খুলে ফেলার পর তার কোনো সম্মান আর বাকি ছিল কি? আপনি তার কী রক্ষা করলেন? চরম বিপদের সময় আপনি সবাইকে রক্ষা করেন বলে আপনার নাম আপাদবান্ধব। বিপদের সময়ই যদি আপনি সাহায্য না করলেন,তাহলে এ সাহায্যের অর্থ কী? এই কি ধর্ম?” প্রশ্নগুলো করতে করতে উদ্ধবও অঝোর নয়নে কান্না করছিলেন। আসলে এ প্রশ্ন শুধু উদ্ধবের একার নয়; যারা মহাভারত পড়েছে, তাদের অনেকের মনেই এ একই প্রশ্নের উদয় হয়, উদ্ভব অনেক আগেই ভগবানকে জিজ্ঞেস করেছেন।

আর তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ হেসে বললেন, প্রিয় উদ্ধব, এ পৃথিবীর নিয়ম হলো শুধু তারাই জেতে যাদের বিবেক (ভালো-মন্দ পার্থক্যের বিচারবোধ) আছে। যুধিষ্ঠিরের বিবেক কাজ করেনি যখন দুর্যোধনের বিবেক কাজ করেছিল, তাই দুর্যোধনের জয় হয়েছিল।” শ্রীকৃষ্ণের কথায় উদ্ধব আরো দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলতে লাগলেন, “দুর্যোধনের অনেক সম্পদ ছিল, কিন্তু সে পাশা খেলতে জানতো না, তাই সে মামা শকুনিকে তার জায়গায় খেলতে বলেছিল। এটা বিবেক। ঠিক একইভাবে যুধিষ্ঠির মহারাজও আমাকে তার হয়ে খেলতে বলতে পারতো, যেহেতু আমিও সম্পর্কে তার পিসতুত ভাই। কে জিততো, খেলাটা যদি আমার আর শকুনি মামার মধ্যে হতো? তোমার কী মনে হয় উদ্ধব? আমি কী করে যুধিষ্ঠিরকে ক্ষমা করি, যখন সে আমাকেই ভুলে গিয়েছিল?”“বিবেকবর্জিত অবস্থায় সে আরো একটা বড় ভুল করে বসল; সে প্রার্থনা করল, আমি যেন পাশার ওই সভাতে না যাই, আর তার এ প্রতারণার শিকার হয়ে বাধ্য হয়ে পাশা খেলার পরিণতির কথা না জানি। সে প্রার্থনা দিয়ে পাশার ওই সভার বাইরে আমাকে বেঁধে ফেলল, আমি তো বাইরে অপেক্ষা করছিলাম, আর প্রত্যাশা করছিলাম কেউ অন্তত আমাকে ভেতরে আসার প্রার্থনা করুক।