নেতাজি নাকি নেহেরু! জেনে নিন, ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন?

173

অর্কপ্রভ সেনগুপ্তঃ স্বাধীন ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নিঃসন্দেহে ছিলেন পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু। এখানে একটি প্রচলিত ভুল ধারণা আছে, যেটা আমার নজরে এসেছে – যে যেহেতু নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু “আর্জি হুকুমত-এ-আজাদ হিন্দ”-এর প্রধাণমন্ত্রী ছিলেন, সেই কারণে তাঁকেই, স্বাধীন ভারতের না হলেও, ভারতবর্ষের প্রথম প্রধাণমন্ত্রী বলা উচিত। এই ধারণাটা থাকা অস্বাভাবিক না। এটা আমি দেখেছি নেতাজির প্রপৌত্র চন্দ্র কুমার বসুও একাধিক সভায় ও ভাষণে বলেছেন। কয়েক বছর আগে ভারত সরকারের তরফেও এই ধরণের প্রস্তাব উঠেছিল। আমার স্মৃতি যদি খুব দুর্বল না হয়ে থাকে, কয়েক বছর বেশ কয়েকটি নামী সংবাদপত্র ও পত্রিকা এই নিয়ে বেশ সুখপাঠ্য কয়েকটি প্রবন্ধও প্রকাশ করে এবং বেশ কিছু রাজনৈতিক সংগঠনের মুখপত্রেও এই ধরণের বক্তব্য প্রকাশিত হয়। সুতরাং সাধারণ মানুষের মধ্যে এই ধারণা থাকা একেবারেই স্বাভাবিক। এই বক্তব্যের যুক্তি হচ্ছে – যেহেতু ভারতের প্রথম অস্থায়ী সরকারের প্রধাণমন্ত্রী সুভাষচন্দ্র ছিলেন, তাই ‘প্রথম প্রধাণমন্ত্রী’-এই সম্মান তাঁর প্রাপ্য। কিন্তু এই ভাষ্যটির গোড়াতেই গন্ডগোল আছে। নেতাজির সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের প্রায় তিন দশক আগে, ১৯১৫ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় আরেকটি অস্থায়ী ভারত সরকার গঠিত হয়েছিল। এটিই ছিল প্রথম অস্থায়ী ভারত সরকার এবং এর প্রতিষ্ঠার সাথে আরেকজন বসুর নাম জড়িয়ে আছে, রাসবিহারী বসু।

এই সরকারের নাম ছিল “হুকুমত-ই-মোক্তার-ই-হিন্দ”। এর রাষ্ট্রপতি ছিলেন মহেন্দ্র প্রতাপ ও প্রধাণমন্ত্রী ছিলেন মাওলানা বরকতুল্লাহ। সুতরাং যদি আমরা অস্থায়ী সরকার ধরি, ভারতের প্রথম প্রধাণমন্ত্রী ছিলেন মাওলানা বরকতুল্লাহ। মাওলানা বরকতুল্লাহ অসাধারণ মানুষ ছিলেন, একাধারে তিনি ব্যক্তিগত ধার্মিক (যদিও পরের দিকে ধর্ম সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে গিয়েছিলেন), অন্যদিকে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের পক্ষে বারংবার কলম ধরেছেন। তাঁর বিভিন্ন মতাদর্শের দিকে ঝোঁক ছিল, কিন্তু কোনো কিছুকেই তিনি সাদা কাগজে সই দিতেন না। তিনি একই সাথে লেনিন আর ট্রটস্কির থেকেও ভারতের স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে সাহায্য নিয়েছেন আবার কাইজার দ্বিতীয় উইলহেলমের ইম্পিরিয়াল জার্মানির থেকেও সহায়তা নিয়েছেন – এইখানে তাঁর সাথে সুভাষচন্দ্রের মিল আছে, ভারত স্বাধীন করতে যে আমাকে সাহায্য করবে – আমি তার সাথেই যাব। তিনি ‘গদর পার্টি’-র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, লালা লাজপত রাই ও রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী অভেদানন্দের বন্ধু ছিলেন, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁকে প্রেরণা হিসেবে দেখেছেন। এককথায় তিনি ছিলেন এক অসাধারণ মানুষ, একই কথা খাটে এই সরকারের রাষ্ট্রপতি মহারাজা মহেন্দ্র প্রতাপের ক্ষেত্রেও। এঁদের রাজনৈতিক বাজারদর নেই, ওইজন্য এঁদের নাম আপনারা শোনেন না – নেতারাও দেশপ্রেমের ঢাক পেটানোর সময় সযত্নে এড়িয়ে যান (অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয়তো নামও শোনেন নি), তবু আমি বলব যদি জানতে চান, ‘অগ্নিযুগ’-সিরিজের যে ঐতিহাসিক দলিল ও গ্রন্থের সংকলণ আছে, ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত-র নিজের রচনা আছে তা থেকে অনেক কিছুই জানতে পারবেন এই বিষয়ে।

যাই হোক, মোট কথা হল – স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধাণমন্ত্রী যে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরু ছিলেন, তাতে সন্দেহের অবকাশই নেই। আর অস্থায়ী সরকারের হিসেব ধরলে – ‘ইন্দো – জার্মান ষড়যন্ত্র’ (ব্রিটিশরা ওই নামেই এই স্বাধীনতা প্রয়াসকে চিহ্নিত করত)-এর হাত ধরেই প্রথম ভারতবর্ষের অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়। আর এই সরকারের প্রধাণমন্ত্রী ছিলেন মাওলানা বরকতুল্লাহ। সুতরাং, যে হিসেবে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে ভারতের প্রথম প্রধাণমন্ত্রী বলা হচ্ছে, সেই হিসেবে তিনি নন – ভারতের প্রথম প্রধাণমন্ত্রী মাওলানা বরকতুল্লাহ।