ব্যর্থতা সফলতার চাবিকাঠি! যা চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল কেএফসির বুড়ো স্যান্ডারস

বুড়ো বয়সে ভিমরতি বলে একটা কথা প্রচলিত রয়েছে আমাদের সমাজে। চাকরি শেষ, অবসর সময় মানে চুপচাপ ঘরে বসে থাকা আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া কিছু যেন চাওয়া পাওয়া নেই। অধিকাংশ লোকেরই এমন ভাবনা অবাক করা নয়। কিন্তু তার মধ্যে ব্যতিক্রম যে কেউ নেই তা কিন্তু নয়। তেমনি এক উদ্যমী এবং সফল উদ্যোক্তা হলেন হারল্যান্ড স্যান্ডারস। ৬৫ বছর বয়সে তার জীবনের মোড় পাল্টে যায় এক অদ্ভুত নাটকীয় ঘটনায়।

১৮৯০ সালে জন্ম আমেরিকার ‘ইন্ডিয়ানা’ স্টেটে। আর বাড়িটা ছিল ইন্ডিয়ানার হেনরিভ্যালি থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে। মাত্র ছয় বছর বয়সে পিতাকে হারানোর পর যেন সংসারের সকল চাপ নিজের কাঁধের উপর উঠে আসে। যখন তার মা বাইরে কাজ করতে যেতেন, স্যান্ডারসকে তার ছোট ভাই ও বোনটিকে দেখে শুনে রাখতে হত। মাত্র সাত বছর বয়সেই বেশ ভাল রান্না শিখে গিয়েছিলেন তিনি। কারণ ছোট ভাই-বোনের খাওয়ার দায়িত্ব তো ছিল তার কাঁধেই। ১২ বছর বয়সে তার মা নতুন বিয়ে করলে সৎ বাবার আশ্রয়ে খুব বেশিদিন কাটাতে পারেননি তিনি। পরবর্তীতে একটা ফার্ম হাউজে কাজ নিয়ে চলে আসেন অনেকটা দূরে। পড়াশোনাও খুব বেশিদিন চালিয়ে যেতে পারলেন না। এর পর থেকে শুরু হয় তার প্রতিকূল পথচলা। মূলত, ১৬ বছর বয়সে স্কুল থেকে ঝড়ে পড়েন । ১৭ বছরের মাথায় মোট ৪ বার চাকরী হারিয়েছিলেন।  ১৮ বছর বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসেন। ১৯ বছর বয়সে তিনি বাবা হন। ২০ বছর বয়সে তার স্ত্রী তাঁকে ফেলে রেখে চলে যায় আর কন্যা সন্তানটিকেও নিয়ে যায় সাথে। এরপর সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন এবং সেখানে ব্যর্থ হন । ইনস্যুরেন্স কোম্পানীতে যোগদান করেন এবং সেখানেও সফলতার দেখা পান নি । এরপর অর্থাভাবে নিজের মেয়েকে নিজেই অপহরণ করতে গিয়েছিলেন এবং সেখানেও ব্যর্থ হন। চাকরী নিয়েছিলেন রেললাইনের কন্ডাকটর হিসেবে, সুবিধে করতে পারেন ন । অবশেষে এক ক্যাফেতে রাধুনীর চাকুরী নেন। ১৯৩০ সালের দিকে স্যান্ডারস কেন্টাকিতে একটি পেট্রোল স্টেশনের পাশে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য বিক্রয় করতে লাগলেন। নিজেই রান্না করে বিভিন্ন সাউথ আমেরিকান খাওয়ার পরিবেশন করতেন। ধীরে ধীরে খাবারের খ্যাতি আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে জায়গাটিকে পুরো রেস্টুরেন্টে রূপ দেন। তার প্রথম সফলতা আসে যখন ১৯৩৯ সালের দিকে তার সিগনেচার রান্না নতুনভাবে সকলের সামনে উপস্থাপন করেন। তিনি নিজেই একটি এমন প্রেসার কুকার তৈরি করে নেন যা ছিল প্রচলিতগুলোর চেয়ে আলাদা। কিন্তু এই প্রেসার কুকারে ফ্রাইড চিকেনের টেক্সচার বা মচমচে ভাবটা খুব ভালভাবেই আসে। এর পরের দশ বছর বেশ ভালভাবেই কাটে স্যান্ডারসের। ১৯৫০ সালে কেন্টাকির গভর্ণর তাকে ‘কর্নেল’ উপাধি দেন যা একটি স্টেটের পক্ষে ছিল সর্বোচ্চ সম্মান। এরপর সেন্ডারস নিজের আইকনিক লুকের জন্য সাদা স্যুট এবং কেন্টাকি কর্নেল টাই পরিহিত হয়ে সবার সামনে ধরা দেন। আর এই পোশাকই তাকে আধুনিক যুব সমাজে অন্যতম আইকন হিসেবে জাহির করে। ১৯৫২ সালের দিকে তার এই ব্যবসা নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেন স্যান্ডারস। তার এক ব্যবসায়িক বন্ধু পিট হারমেনের সাথে চুক্তি করেন যে তার তৈরি “Kentucky Fried Chicken” এর প্রতিটি মূল্যের সাথে রয়্যালটি হিসেবে চার সেন্ট করে পাবেন। এই চুক্তির ব্যাপক সাফল্যের পর সেন্ডারস আরও কিছু রেস্টুরেন্টের সাথে অনুরূপ চুক্তি করেন। সবকিছু বেশ ভালভাবেই চলছিল। কিন্তু হঠাৎ সরকারি জায়গা অধিগ্রহণের বেড়াজালে পড়ে বিশাল ক্ষতিতে বিক্রয় করতে বাধ্য হন তার রেস্টুরেন্ট। হাতে পড়ে থাকে শুধুমাত্র ১০৫ ডলারের সিকিউরিটি চেকের অর্থ। কিন্তু স্যান্ডারস হার মেনে নেয়ার পাত্র নন। তার চার বছর আগে ফেলে আসা ব্যবসায়িক চিন্তাকে নতুন করে গড়ে তোলার জন্য বদ্ধ পরিকর হলেন। তার গাড়ি ভর্তি করে নিলেন প্রেসার কুকার, ময়দা, মুরগি, তার নিজের তৈরি রেসিপির অন্যান্য উপকরণ আর ঘুরতে লাগলেন রেস্টুরেন্ট থেকে রেস্টুরেন্ট। উদ্দেশ্য একটাই, যদি ভাল লেগে যায় তার রেসিপি, তাহলেই চুক্তিবদ্ধ হবেন।

কাজটা শুনতে যতটাই সহজ মনে হোক না কেন, বস্তুত ছিল অনেক কষ্টসাধ্য। অনেক রেস্টুরেন্টের দ্বারে দ্বারে যেতে হয়েছিল তার। কেউ শুনেই হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল, কেউ বলেছিল পাগল, আবার কেউ রেসিপি পছন্দ করেও কোনো প্রকার চুক্তি করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিল। কিন্তু থেমে থাকেননি বদ্ধ পরিকর। চেষ্টা এক সময় সফলতায় রূপ নিল। ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত তার চেষ্টায় প্রায় ৬০০টি রেস্টুরেন্টের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতে পেরেছিলেন। সেই বছরই অক্টোবর মাসের দিকে ‘জেক সি মেসি’ নামে একজন ধনাঢ্য ব্যক্তির কাছ থেকে তার রেসিপির রয়্যালিটির অধিকার কিনে নেয়ার আবেদন পান।

শুরুর দিকে কোনো আগ্রহই দেখাননি বদ্ধ পরিকর। কিন্তু পরবর্তীতে চিন্তা করে দেখলেন, তার এই রেসিপি শুধুমাত্র পারিবারিক উত্তরাধিকার হিসেবে না রেখে পুরো বিশ্বে ছড়িয়ে দিলে তার যশ আর খ্যাতি হয়ে থাকবে চিরন্তন। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে তার জগত ভোলানো রেসিপির অধিকারস্বত্ব দুই মিলিয়ন ডলারে বিক্রয় করেন তিনি। চুক্তিপত্র অনুযায়ী Kentucky Fried Chicken কোম্পানি হিসেবে পুরো বিশ্বে নিজস্ব রেস্টুরেন্ট খুলবে এবং রেসিপির ব্যাপারে কোনো প্রকার ছাড় দেয়া হবে না। স্যান্ডারস সারা জীবনের বেতন হিসেবে ৪০,০০০ ডলার পাবেন, অধিকাংশ শেয়ারের মালিক হবেন এবং কোম্পানির ব্র্যান্ড এম্বেসেডর হয়ে কোম্পানির প্রচারে অংশগ্রহণ করবেন। ১৯৮০ সালের তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত স্যান্ডারস ছুটে বেড়িয়েছে মাইলের পর মাইল তার হাতে গড়া রেসিপির কদর আর মান দেখার জন্য। কখনো গুণাগুণের ব্যাপারে সমঝোতা করেন নি। সব সময় চেয়েছেন নিজের তৈরি রেসিপি নিয়ে মানুষের মনে বেঁচে থাকতে। তার চাওয়া যে সফলভাবে পাওয়াতে পরিণত হয়েছে তা তো সময়ই প্রমাণ। তাই মন থেকে কিছু চেয়ে সঠিকভাবে লেগে থাকলে সফলতা আসবেই। নয়তো যে বয়সে সব হারানোর ব্যথায় নিজেকে লুকিয়ে রাখার কথা, সেই বয়সে নতুন উদ্দীপনায় নতুন কৌশলে নিজেকে জাহির করলেন অন্য এক মাত্রায় এই পৃথিবীর বুকে। তাই জীবনে কিছু করে দেখানোর জন্য বয়সকে আমলে না নিয়ে কি করে যেতে চাই সেটাতে জোর দেয়া উচিৎ।