ইতিহাসের আলোকে ডাকাতসর্দার ভবানী পাঠকের মন্দিরের কালী পুজো

606

সৌমেন জানা:  নিস্তব্ধ রাতের নীরবতাকে ভেঙ্গে দিয়ে অবিরাম ডেকে চলেছে ঝিঁ ঝিঁ পোকারা।
আকাশে শুক্লপক্ষের উজ্জ্বল চাঁদ, দিগন্ত জুড়ে জমাটবাঁধা অন্ধকার ।আকাশে
চলছে চাঁদ আর মেঘের লুকোচুরি খেলা। কখনোও চাঁদ মেঘের আড়ালে লুকাচ্ছে ,
কখনোও জোছনার রুপালি আলোতে চারদিক ভরে উঠছে। এর মাঝে আবার জোনাকিদের
টিমটিমে আলোটুকু বিলিয়ে দেবার প্রচেষ্টা চলছে। অদূরে কোথাও থেকে ভেসে
আসছে শেয়ালের ডাক, নীরব নিঝুম চরাচরে হঠাৎ জেগে ওঠা পাখিদের কলকাকলি,
অদ্ভুত মায়াময় পরিবেশ।এমনই চাঁদনীরাতে ত্রিস্রোতা নদীর জল ছল ছল কল কল
শব্দে বয়ে চলেছে ।উচ্ছল নদীর জলে ছোট ছোট ঢেউ উঠছে।চাঁদের আলো নদীর জলের
উপর পড়ে চিক চিক করে উঠছে।চারিদিকে জোছনা যেন হাসছে।নদীর দুই পাড়ের
গাছেরা একে অপরের সাথে করমর্দন করার ভঙ্গিতে কঞ্চি আর লতায় জড়িয়ে তৈরী
করেছে চাঁদোয়া। এমন সময় নদীর বাঁকে দেখা গেল এক ময়ূরপঙ্খী নৌকা । নদীর
স্রোতের টানে বজরাটি তর তর করে এগিয়ে আসছে। বজরার কাঠের তৈরী কামরার
দেওয়ালগুলিতে নানা সুদৃশ্য ছবি ঝোলানো।মেঝেতে নরম পুরু গালিচা পাতা,
উজ্জ্বল প্রদীপের আলোয় কামরাগুলি আলোকিত; কামরায় থাকা সোনা-রুপোর
সামগ্রীগুলি ঝক ঝক করে উঠছে। কিন্তু বৈকুন্ঠপুর গভীর জঙ্গলে এই নিঝুম
রাতে এমন বজরাতে কারা? তারা কোথায় যাচ্ছে? ধীরে ধীরে নৌকা নদীর তীরে
জঙ্গলের একপাশে এসে ভিড়ল। অন্ধকারে কারা যেন বজরা থেকে নেমে জঙ্গলের পথে
এগিয়ে চলল ।লতায়-পাতায় খস-খস শব্দ উঠছে।

ঘন গাছপালায় ঢাকা নিবিড় বনের মধ্য দিয়ে এক সরু পথ, সচরাচর অপরিচিত লোকের
চোখে ধরা পড়বে না। নদীর ধার থেকে সেই পথ এসে থামল এক প্রকান্ড বটগাছের
নীচে এসে। পাশে ভগ্ন জীর্ন প্রাচীরে ঘেরা এক ভাঙা মন্দির। কাঠের
সিংহাসনের উপর মা কালীর রুদ্র মূর্তি। মন্দিরের এক কোনে রয়েছে রক্তমাখা
খাঁড়া। মন্দির প্রাঙ্গনে হাড়িকাঠ; যেন কারুর জন্য অপেক্ষা করছে, তার
চারিদিকে মাটিতে পড়ে আছে চাপ চাপ রক্ত।

কী ভীষন নীরবতা, দুর-দুরান্তে কোন লোকালয়ের চিহ্ন নেই।মন্দিরে কোন
পুরোহিতের দেখা মিলল না। মন্দিরের ভাঙা দরজা দিয়ে প্রদীপের ক্ষীন আলোতে
মা কালীকে দেখে মনে হল তিনি ভীষন রক্তলোলুপা, তাঁর রক্তচক্ষু দেখে মনে
হচ্ছে তিনি যেন বলছেন রক্ত দে-রক্ত দে! এমন সময় জঙ্গলের সরু পথ ধরে
মন্দিরের সামনে উপস্থিত হল কয়েকজন লোক; লন্ঠনের আলোয় তাদের ভীমাকার
চেহারা চোখে পড়ল, মাথায় ঝাঁকড়া চুল।হাতে তাদের লম্বা লম্বা লাঠি আর
সড়কি, তাদের সাথে পিছমোড়া করে বাঁধা একজন লোক।লোকগুলোর বসন-ভূষন দেখে
মনে হল কোন দস্যুর দল। একজন শুভ্র-কেশ বয়স্ক লোক ডাকলেন; “ মা! মা! আমরা
সেই নরপিশাচকে ধরে এনেছি তোমার কাছে। এবার তুমি এর অন্যায়ের বিচার কর”।

মন্দিরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন অল্পবয়সী এক অপরূপা সুন্দরী।দেখে মনে হল
সদ্য তিনি পঁচিশের কোঠায় পা দিয়েছেন।দস্যুরা সবাই তাকে করজোড়ে নমস্কার
করল। মা বলে উঠলেন “কিরে নরাধম! আর কতদিন গরীবের রক্ত চুষে খাবি ? এতবড়
দুসাহস তোর? তুই ভবানী পাঠককে ধরতে আসিস!! তোর লোভানলে প্রান দিয়েছে কত
নিরীহ প্রজা, কত অগুনতি নারীর ঘর ভেঙেছিস তুই। আজ থেকে ফকিরকুন্ডি তোর
অত্যাচার থেকে মুক্ত হবে। দেবী চৌধুরানীর বিচারসভা এখানেই শেষ। ওহে
রঙ্গলাল আজ এই পিশাচের রক্তেই মার তৃষ্ণা মেটাব, সব আয়োজন শুরু কর।”

এমন লাবন্যময়ী নারীর হিমশীতল কন্ঠের ঘোষনায় আসামীর ওপর যেন বজ্রপাত হলো।
মন্দির থেকে ভেসে এল………

“পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্।

ধর্মসংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।।”

বেজে উঠল ঢাকের আওয়াজ। চারিদিকে মশালগুলি জ্বলে উঠল।

সময় যেন থমকে গেছে।জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে বইতে পড়া গল্পগুলো যেন চোখের
সামনে ভাস্বর হয়ে উঠল।জলপাইগুড়ির শিকারপুরের চা বাগানে ভবানী পাঠকের
মন্দিরের সামনে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষনের জন্য ফিরে গিয়েছিলাম অতীতের সেই সময়ে
যখন ফকিরকুন্ডি(অধুনা বাংলাদেশের রংপুর) দেবী সিং-এর অত্যাচারে
কম্পমান।ভীত-সন্ত্রস্ত, নিরীহ প্রজাদের বাঁচাতে রবিন হুডের মত হাজির হল
ভবানী পাঠক-দেবী চৌধুরানীর দলবল।এক দুর্নিবার আকর্ষণের বশীভূত হয়ে
মন্দিরের দিকে ক্রমশ এগিয়ে চললাম।

প্রবল খরস্রোতা ত্রিস্রোতা নদী আজ তার গতি হারিয়েছে।ত্রিস্রোতা আসলে
করলা,ধরলা আর তিস্তা নদীর মিলিত প্রবাহ।নগরায়নের সাথে সাথে তারও চরিত্র
বদলেছে। দেবী চৌধুরানী মন্দিরের গা ঘেঁষে বয়ে চলেছে আপাত শুষ্ক
ত্রিস্রোতা নদী৷এখনও মন্দিরের পাশে একটি বটগাছ আছে; যদিও এর প্রাচীনত্ব
সম্পর্কে আমার কোন ধারনা নেই।কালীমন্দিরের পাশেই রয়েছে একটি প্যাগোডা
ধাঁচে তৈরি মন্দিরও। সারা বছর পুজো হয় এই মন্দিরেও। তবে এখানকার বিগ্রহ
নিয়ে নানা মতান্তর রয়েছে। এই মন্দিরে একটি পুরুষ ও একটি নারী মুর্তি
রয়েছে। পাশাপাশি বাঘ, শেয়াল ও আরও কিছু বিগ্রহ আছে। কেউ বলেন, এটি
শিব-পার্বতীর মন্দির।

তবে স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, প্রধান বিগ্রহ দু’টি ভবানী পাঠক ও দেবী
চৌধুরানির। ইতিহাস বলছে, বৈকুন্ঠপুর রাজবংশের এক বংশধর দর্পদেব রায়কত
১৭২৮ থেকে ১৭৯৩ সাল অবধি রাজত্ব করার সময় ভবানী পাঠক নামে এক সন্ন্যাসীর
সংস্পর্শে আসেন। রাজা দর্পদেবেই এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। পরে ১৮৭১ সালে
রাজা যোগেন্দ্রদেব রায়কতের আমলে মন্দিরটির সংস্কার করা হয়।

ডাকাতসর্দার হিসেবেই পরিচিত ছিলেন ভবানী পাঠক, যদিও তিনি সন্ন্যাসীর মতো
জীবনযাপন করতেন। শোনা যায় তিনি অত্যাচারী ইংরেজ ও দেশীয় জমিদারদের ওপর
লুঠতরাজ চালিয়ে তা দীনদরিদ্রদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। তাঁর সুযোগ্য শিষ্যা
ছিলেন দেবী চৌধুরানি।

এই দুই ঐতিহাসিক চরিত্রকে নিয়েই সাহিত্যসম্রাট লিখেছিলেন উপন্যাস ‘দেবী
চৌধুরানী’। যদিও ইতিহাসবিদদের মতে, বাংলাদেশের রংপুরের মন্থনী রাজ
এস্টেটের সর্বময় কর্ত্রী ছিলেন জয়দুর্গা দেবী চৌধুরানি নামে এক তেজস্বিনী
মহিলা।সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তাঁকেই কল্পনায় দেবী
চৌধুরানি হিসাবে রূপ দিয়েছিলেন। তবে ইতিহাস যা-ই বলুক না কেন, স্থানীয়
বাসিন্দাদের কাছে কিন্তু ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানি এখনও দেবতা হিসাবে
আরাধ্য।

প্রথমে কাঠের মূর্তি তৈরি করা হলেও তা পুড়ে যাওয়ায় পরে মাটির প্রতিমা
তৈরি করা হয়েছে ভবানী পাঠক ও দেবী চৌধুরানির।যদিও অন্য মুর্তিগুলি এখনও
কাঠের। কাঠের তৈরি মণ্ডপটির অবস্থাও ভালো নয়।সালংকারা দেবী মুর্তিটি
দৃষ্টি আকর্ষন করে৷ মাতৃস্নেহে ভরা হাস্যমুখ আর দীপ্ত চোখ দুটিতে দেবী
যেন দৃঢ়তা ও সাহসিকতার প্রতিমূর্তি৷ এখন রাজা নেই, নেই রাজ্যপাটও।
কিন্তু রয়ে গেছে প্রতিবছর পুজোর রেওয়াজ।সময়ের কি অদ্ভুত পরিহাস রাজার
পুজো সামলাচ্ছেন প্রজারা।জলপাইগুড়ির শিকারপুর গ্রামে চা বাগান ঘেরা এই
মন্দিরকে নিয়ে ছড়িয়ে আছে নানা মিথ।

পলাশীর যুদ্ধের পর ১৭৬৫ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ফকিরকুন্ডির দেওয়ানি
লাভ করে ইতিহাস-কুখ্যাত দেবী সিংকে তার ইজারাদার নিযুক্ত করেন।তার
অমানুষিক অত্যাচারে কৃষকরা নিঃস্ব হয়ে পড়েন।অত্যধিক খাজনা দিতে না পারায়
দলে দলে কৃষকদের জেলে পাঠানো হয়। সহায়-সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
কৃষকদের ধরে এনে পিঠে চাবুকের কষাঘাত করা হয়, তাদের কুঁড়ে ঘরগুলিকেও
আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।নারীদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়। কৃষকেরা
তাদের লাঙ্গল, বলদ, বাড়ি-ঘর সবই হারায়।ভবানী পাঠক ১৭৬০ সাল থেকে কর
আদায়কারী, উৎপীড়নকারী জমিদার শ্রেণীর থেকে টাকা পয়সা লুট করে সাধারণ
মানুষের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন।তিনি পার্শ্ববর্তী গভীর জঙ্গলে তার ডেরা গড়ে
তোলেন। ভবানী পাঠক রংপুর জেলার বিভিন্ন গভীর অরণ্যে দেবী চৌধুরানীর
সহযোগীতায় সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তোলেন। পীরগাছা মন্থনার জমিদার দেবী
চৌধুরানী ভবানী পাঠকের আদর্শে দীক্ষা গ্রহণ করে তার আন্দোলনকে আরও
শক্তিশালী রূপ দেন। এভাবে তিস্তা নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন গভীর জঙ্গল, ধরলা
ও পয়রাডাঙ্গা নদীর তীরবর্তী বিভিন্ন স্থান, উলিপুর, মরাতিস্তা, পীরগাছা
ও চৌমুহনীতেও সন্ন্যাসীদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র তথা দুর্গ গড়ে ওঠে।

ভাবতেও অবাক লাগে, আজ যেখানে দাঁড়িয়ে আছি সেখানে কোন একসময় হয়ত দেবী
চৌধুরানী ও ভবানীপাঠক ফকির সন্ন্যাসীদের সঙ্গে মাঝে মধ্যে গোপন বৈঠকে
মিলিত হতেন।

কোম্পানী ও দেবী সিং-এর বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে ভবানীপাঠক ও দেবী
চৌধুরানীর ফকির সন্ন্যাসী বাহিনী প্রচন্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কোম্পানীর
বাহিনী সাঁড়াশী অভিযান চালায়। কিন্তু বিদ্রোহী ফকির সন্ন্যাসীরা
প্রচন্ড সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে কোম্পানী ও দেবী সিং-এর বাহিনীকে
পরাজিত করে। ইংরেজ ক্যাপ্টেন ক্রকেনসহ বেশ কিছু শত্রু সৈন্য নিহত হয়
মাসিমপুরের এই যুদ্ধে। অন্যদিকে ফকির সন্ন্যাসীদের পক্ষে বীরত্বের সঙ্গে
যুদ্ধ করতে গিয়ে দলীব খাঁ ও আসালত খাঁ সহ অনেকেই নিহত হন।

ফলে ইংরেজ শাসকদের তরফ থেকে ভবানী পাঠককে গ্রেফতার করার জন্য সশস্ত্র
লোকজনসহ পরোয়ানা পাঠানো হয় ।অবশেষে লেফটেন্যাণ্ট ব্রেনামের নেতৃত্বে একটি
ইংরেজ সেনাদল পাঠানো হয় ।

১৭৮৭ সালের জুন মাসে রংপুর জেলার গোবিন্দগঞ্জের কাছে ভবানী পাঠক ইংরেজ
সেনাদলের বেষ্টনের মধ্যে পড়ে যান । সেই জলযুদ্ধে তাঁর দল পরাজিত হয়, তিনি
নিজে নিহত হন, নিহত হন তাঁর পাঠান সহকারীসহ অপর দুই জন সহযোদ্ধা । আহত ও
বন্দি হন আরো ৪২ জন । এছাড়া বিদ্রোহীদের ‘অস্ত্রশস্ত্রপূর্ণ সাতখানি
নৌকা’ ইংরেজ বাহিনীর হস্তগত হয়। এরপর থেকে দেবী চৌধুরানীর ইতিহাস
ধোঁয়াসা।

পীরগাছা মন্থনার একজন ছোট জমিদার হওয়া সত্ত্বেও দেবী চৌধুরানী তার
বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের কারণে বৃহত্তর রংপুর অঞ্চলে ‘জয় দূর্গাদেবী’
বা ‘চন্ডী মা’ নামে জনসাধারণের নিকট শক্তির উৎস ও ভরসাস্থলে পরিণত হন।
তার নামানুসারে দেবী চৌধুরানী নামক একটা এলাকা ও রেলস্টেশন আজও তার
পূণ্যস্মৃতি বহন করে চলছে।শিকারপুরে ভবানী পাঠকের মন্দিরটি অমন প্যাগোডা
আকৃতির কেন সে প্রশ্ন রয়েই গেল৷ বিস্তির্ণ চা বাগানের কোণে ওই মন্দিরে
কালীমূর্তি ছাড়াও ভবনী পাঠক, রঙ্গলাল ও দেবী চৌধুরানী পূজিত হন৷

পরবর্তীকালে বঙ্কিমচন্দ্র রংপুর জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্ব পালনকালে
এই ঘটনা জানতে পারেন এবং দেবী চৌধুরানী নামে উপন্যাস লেখেন।

বঙ্কিমচন্দ্রের “ দেবী চৌধুরাণী”-তে আমরা দেখতে পাই রঙ্গরাজ কাঁদতে
কাঁদতে মাকে বিদায় দিচ্ছে আর মা তাদের বলছেন; “দেবতার ভোগ হয়, প্রসাদ
খাইয়া দিনপাত করিও। আর কখনও লাঠি ধরিও না। তোমরা যাকে পরোপকার বল, সে
বস্তুতঃ পরপীড়ন। ঠেঙ্গা লাঠির দ্বারা পরোপকার হয় না। দুষ্টের দমন রাজা না
করেন, ঈশ্বর করিবেন–তুমি আমি কে? শিষ্টের পালনের ভার লইও–কিন্তু দুষ্টের
দমনের ভার ঈশ্বরের উপর রাখিও।”এখানে হয়ত বাস্তবের দেবী চৌধুরানী
প্রতিফলিত হয়নি, কারন ইতিহাস সেকথা বলে না, তিনি প্রজামঙ্গলের জন্য
অহিংসার পথ অবলম্বন করেছিলেন বলে শোনা যায় না।

চা বাগানের পাশের ত্রিস্রোতা নদী ধরেই কখনও ছিপ নৌকা কখনও বজরা নিয়ে ছিল
দেবী চৌধুরানীর যাতায়াত৷তার সাহসিকতার স্মৃতি সম্বল করে এখনও
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলছে মন্দিরগুলি।মন চাইলে এখানে পুজো দিতে পারেন৷ দিনের
শেষে বটের ঝুড়ির ফাঁক-ফোকড়ের মধ্য দিয়ে সূর্যাস্ত দেখুন প্রাণভরে৷ তারপরই
মন্দির প্রাঙ্গনে গোধূলির লগ্নে সন্ধ্যারতি এবং ঝিঁঝিঁর কনসার্ট, কাসার
ঘণ্টার ধ্বনি আর পিদিমের আলোয় মনে হবে যেন ঐ মুহূর্তেই আপনি পৌঁছে
গিয়েছেন কয়েক শতাব্দী প্রাচীন বনভূমিতে যেখানে কম্পমান মশালের আলোয় আপনি
শুনতে পাবেন বিদ্রোহী সন্ন্যাসীদের চাপা স্বরের শব্দ৷কানের কাছে কেউ যেন
ফিসফিসিয়ে বে যাচ্ছে “ঐক্যং স্মরণম গচ্ছামি। সত্যম শরণং গচ্ছামি। স্বরাজ
শরণম গচ্ছামি”। ইতিহাস ও স্থানীয় লৌকিক রুপকথার এক অনবদ্য মিশ্রণ।

পনের-কুড়ি বছর আগে বৈকুণ্ঠপুর বন সংলগ্ন চম্পাসারিতে মহানন্দার তীরে একটি
নৌকা পাওয়া গিয়েছিল৷ Paleo Botany-তে তা পাঠানো হয়েছিল নৌকার কাঠের বয়স
নির্ধারণের জন্য৷ ওই বিভাগের প্রতিবেদনে লেখা হয় যে ওই কাঠ দু’শো বছরের
পুরনো৷ অর্থাত্ দেবী চৌধুরানীর সময়কালের সঙ্গে ওই কাঠের বয়স
সামঞ্জস্যপূর্ণ৷ ঐতিহাসিক বজরাটি উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অক্ষয়কুমার
মৈত্রেয় হেরিটেজ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে৷ তবে নীরবে ভবানী পাঠক-দেবী
চৌধুরানীর ঐতিহাসিক সাক্ষ্য বহনকারী ঐতিহ্যপূর্ণ এই জায়গাগুলির নবায়ন
হওয়া খুব জরুরি৷ তবেই তাদের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন হবে৷

তবে বর্তমানের মাটিতে দাঁড়িয়ে ভবানী পাঠক-দেবী চৌধুরানীর প্রয়াস কতটা
সফল হয়েছে সেবিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে৷ কারন আজও চা বাগানের অধিবাসী
ওঁরাও, হেমব্রমরা দুর্দশাগ্রস্ত৷ পট পরিবর্তন হয়েছে, সময়ও পালটে গেছে,
কিন্তু এদের দুর্দশার কোন পরিবর্তন হয়নি৷বহু ঐতিহাসিক ঘটনার নীরব সাক্ষী
এই জায়গাগুলি, লোকগুলি আজ যেন আমদের বলতে চায় “আমরা ভাল নেই”৷এখানে
বর্তমানের শিলাপাথরে ঘসা খায় অতীতের গা বেয়ে আসা ইতিহাসের ফিসফিসানি
বাতাস ; যেন বলে যায় , “এইতো আমি – ছিলাম, আছি”।

ভুটান, আসাম, নেপাল, সিকিমের রাজনৈতিক ইতিহাসের পটভূমি আর পূর্ব হিমালয়ের
পর্বতমালা, গিরিবর্ত, ঘন জঙ্গলে ঘেরা প্রকৃতি, বন্যপ্রানের বৈচিত্র্য আর
জনজাতির জীবনযাত্রায় উত্তরবঙ্গের জঙ্গল যেন আজও আদিম, ভয়ংকর সুন্দর,
মায়াবী আর ভীষন সবুজ৷