ব্রিটিশদের নজর এড়িয়ে নেতাজির মহানিষ্ক্রমণের কাহিনী আজ শরীরে কাঁটা দেয়

2935

স্বপন সেনঃ নেতাজি তখন কলকাতার এলগিন রোডের বাড়িতে নজরবন্দি । বাইরে সবসময় ব্রিটিশ পুলিশ ও গোয়েন্দারা নজর রাখছেন তাঁর গতিবিধির ওপর। এই সময় তিনি একদিন বাড়িতে ঘোষণা করলেন, এরপর আর কারও সাথে সাক্ষাৎ করব না। এখন থেকে নিজেকে আমি ডুবিয়ে রাখতে চাই আধ্যাত্বিক সাধনার মধ্যে। সেই ঘরের একপাশে ছিল একটা বাঘের চামড়া। তার সামনে রাখা ছিল গীতা, আর জপমালা। সেখানে বসেই সারাদিন জপ আরতি করতেন নেতাজী। ঘরের পর্দা এমনভাবে টাঙ্গানো ছিল তাতে বাইরে থেকে কিছুই দেখা না যায়। এমনকি ওনার খাবার দাবার যা কিছু দেওয়া হতো, সব ঘরের বাইরে দরজায় রাখা হতো। পরে উনি সময়মত খেয়ে নিতেন।

গৃহত্যাগের কয়েকদিন আগে নেতাজির পরিকল্পনা অনুযায়ী শিশির বসু ও মিঁয়া আকবর শাহ মিলে ধর্মতলার ওয়াছেল মোল্লার দোকান থেকে নেতাজির ছদ্মবেশের জন্য একটা পাজামা, শেরওয়ানি, জিন্না টুপি কিনে ছিলেন। এছাড়া বালিশ, চাদর, লেপ, হোল্ডার আরও অনেক কিছু কলকাতার নিউমার্কেট ও চাঁদনি থেকে শিশির বসু ঘুরে ঘুরে কেনেন। এরপর করা হল ভিজিটিং কার্ড। সেটা আবার কলকাতার রাধা বাজারের এক প্রেস থেকে ছাপানো হয়।
কার্ডে লেখা হয়- মহম্মদ জিয়াউদ্দিন, ট্রাভেলিং ইন্সপেক্টর, দা এম্পায়ার অফ ইন্ডিয়ান লাইফ অ্যাসিওরেন্স কোম্পানি লিমিটেড। পার্মানেন্ট অ্যাড্রেস–সিভিল লাইন, জব্বলপুর। অবশেষে এলো সেই স্মরণীয় #১৬ই_জানুয়ারী, ১৯৪১ সাল!
ঘড়ির কাঁটায় রাত একটা বেজে পঁচিশ। সময় নেই আর। আগে থেকেই ছোড়দা ডাক্তার সুনীল বসুর পোষা অ্যালসেসিয়ান কুকুরটা যাতে রাতে চিৎকার না করে, তাই অন্য জায়গায় বেঁধে রাখা হয়। সুভাষ ঢোলা পাজামার সঙ্গে গায়ে বাদামি রঙের গলাবন্ধ শেরওয়ানি, মাথায় জিন্না টুপি, চোখে দশ বছর আগের ব্যবহার করা গোল ফ্রেমওয়ালা রোল্ড গোল্ডের চশমা পরে তৈরি। পায়ে ইউরোপে থাকাকালিন পুরোনো বুটটা পরলেন। প্রস্তুতি শেষ।
অপেক্ষায় থাকলেন কখন ভাইপো দ্বিজেন কাশির শব্দ করবেন। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল রাস্তায় ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের ওপর নজর রাখার। শেষমেশ দ্বিজেনের গলায় কাশির শব্দ শুনে নেতাজী বেরিয়ে পড়লেন। ভাইঝি, ইলার মাথায় হাত রেখে আশির্বাদ করলেন। আর নির্দেশ দিলেন- আমি চলে যাওয়ার পরও অন্তত এক ঘণ্টা যাতে আমার ঘরে আলো জ্বলে থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখবে। ঘুমানোর সময় ঘরের আলো বন্ধ করে দেবে।
এরপর সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা তাঁর জার্মান ওয়ান্ডারার গাড়ির দরজা সাবধানে খুলে ভিতরে বসলেন। কিন্তু দরজা বন্ধ করলেন না, শক্ত হাতে দরজার হাতলটা ধরে রইলেন। মিনিট খানেকের মধ্যে ড্রাইভারের আসনে বসলেন শিশির বসু এবং গাড়ির দরজা বন্ধ করলেন। কিন্তু নেতাজি তখনও শক্ত হাতে ধরে রইলেন তাঁর দিকের দরজার হাতলটা। কেননা, দুটো দরজা পর পর বন্ধ হলে কারো সন্দেহ জাগতে পারে।
ভাইপো অরবিন্দ আগেই গাড়িতে হোল্ডলটা তুলে দিয়ে সদর দরজা খোলার জন্য তৈরি ছিলেন।শিশির বসু নিজের বইতে লিখেছেন “বাড়ির সামনের গেট খুলতেই আমি গাড়ি চালু করি। বিকট একটা আওয়াজ করে গাড়ি চালু হয়। দেরি না করে আমি গাড়ি চালিয়ে এগিয়ে যাই তাঁর কথা মতো। প্রথমে দক্ষিণে কিছুটা গেলেও গন্তব্য ছিল উত্তরে। যাঁদের নজরদারিতে থাকার কথা, সেই পুলিশ ও সিআইডি-র লোক ছিল ঘুমিয়ে। তারা একটা অস্থায়ী ছাউনি মতো করেছিল এলগিন রোড এবং উডবার্ন রোডের সংযোগস্থলে, যাতে সেখান থেকেই তারা বাড়ির ওপর ভালো ভাবে নজরদারি করতে পারে। যখন আমরা গাড়ি চালিয়ে বেরিয়েছি, তারা জেগে ছিল না।”
গাড়ি ছুটল নেতাজির পরিকল্পনা অনুযায়ী কলকাতার দক্ষিণ দিক হয়ে হাওড়া ব্রিজ। হাওড়া ব্রিজ থেকে গাড়ি ব্যান্ডেল, বর্ধমান, দূর্গাপুর, আসানসোল হয়ে গাড়ি পৌঁছাল ধানবাদ। পরদিন গোমো স্টেশন থেকে নেতাজী উঠলেন কালকা মেলে, স্বাধীনতার লক্ষে যাত্রা করলেন এক অনিশ্চিতের পথে…..!
ছোটবেলা থেকে এই কাহিনী পড়েই বড়ো হয়েছি। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে এখন শুনছি, এটা নাকি নিছকই একটি গল্প। এভাবে নেতাজী অন্তর্ধান করেননি। ঘটনা যাই হোক, আজ স্মরণ করি সেই মহামানব কে ।