কলকাতার অন্য এক ডেকার্স লেন, ট্রাফিক ঠেঙ্গিয়ে একবার আসুন না বেহালায়

দূর্বা দাসগুপ্তঃ কলকাতার খাওয়া দাওয়া নিয়ে কথা হলেই আসে প্রথমে উত্তর তারপর দক্ষিণ। আদি ও অকৃত্রিম খাদ্যরসিকরা এই দুই প্রান্তকে গুরুত্ব দিতে দিতে অনেক সময়ে ভুলে যান শহরের বাকি জায়গা গুলোর কথা। আমি আজকে বলব সেরকমই এক কাব্যে উপেক্ষিতার কথা। জন্ম থেকে যেইখানে থাকি সেখানের কথা না বললে বেইমানি হবে।আসি শহরের দক্ষিণতম প্রান্তে। দাদার এলাকা, জল জমার এলাকা, বেহাল বেহালা। পঁচিশটা বসন্ত কাটিয়েছি এখানে। আশা করি আরও কয়েকটা কাটাবো। সেই পঁচিশ বসন্তের সঞ্চয়ের ঝুড়ি উপড়ে দেওয়া চেষ্টা করব আপনাদের। তাতে আমার উপেক্ষিতা বাসস্থান একটু পাদপ্রদীপের আলো পাবে, আর খাদ্যরসিকরা নতুন এক দিগন্ত। শুরু করছি বেহালা যেখান থেকে শুরু হচ্ছে সেখান থেকে।

আলিপুর শেষ মানেই বেহালা শুরু। তারাতলা রাসবিহারী অটো স্ট্যান্ডের পাশে পাবেন কৃষ্ণা স্ন্যাকস বার। দক্ষিণ ও উত্তর ভারতের নিরামিষ খাবারের দারুন ঠিকানা। নিরামিষ শুনে নাক কোঁচকাবেন না যেন। ওখানের চাট আর গ্রিন মুগ ধোসা খেয়ে এক গ্লাস লস্যি মেরে দেবেন। তারপর বেরিয়ে পড়বেন। বেরিয়ে ডায়মন্ড হারবার রোডে উঠে একটু এগিয়ে এলেই পাবেন ব্রিজবাসির মিষ্টির দোকান। অবাঙালী মিষ্টির বিশাল সম্ভার। ব্যক্তিগত ভাবে আমার পছন্দ ওদের কেশর লাড্ডু আর ক্ষীর বরফি। মিষ্টি মুখ করে আরও এগিয়ে আসবেন দক্ষিণ দিকে। আপনি পৌঁছে গেছেন আর্সালানে। আর্সালান আমার পছন্দ না। তাই এখানে আমি ঢুকব না। ঢুকব পাশের ছোট্ট মোমোর দোকানটায়। মোমো খাওয়া হলে যদি মনে হয় অনেকদিন বাড়িতে পর্ক ভিন্ডালু বানানো হয়নি তাহলে নিজেকে বাড়ির কথা ভুলে যাওয়ার দোষে দোষী করতে করতে আবার চলে যাবেন কৃষ্ণার পাশে। পর্কের দোকান আছে দুটো পাশাপাশি এবং সেই দুটো খুবই পুরনো। বাবার কাছে শুনেছি বাবার স্কুল বেলাতেও দোকান দুটো ছিল এবং তখনও বেশ প্রাচীন ছিল।

এবার যাবেন বেহালা থানার উল্টোদিকে ক্যান্টন রেস্তোরাঁ তে। আগে যখন বেহালায় ব্যাঙের ছাতার মতো হোটেল রেস্তোরাঁ গজিয়ে ওঠেনি, তখন ক্যান্টনই ছিল এক মাত্র চিনা খাবারের ঠিকানা। মনে পড়ে, মাসির বিয়ে ঠিক হওয়ার পর প্রথমবার মেসোর সাথে দেখা করতে গেছিলাম আমরা ওখানে। তখন আমার বয়স বড়জোর পাঁচ। প্রথমবার স্কুলবেলার প্রেমিকের সাথে পুজোয় লুকিয়ে লুকিয়ে খেতে গেছিলাম ক্যান্টনে। এখন অবশ্য সেই ছোট্টবেলার প্রেমিকও নেই আর ক্যান্টনের খাবারের সেই স্বাদও নেই। কিন্তু কিছু কিছু জিনিস আবেগে কাটে। আপনাদের যদি ওখানে যেতে ইচ্ছা না করে তাহলে চিন্তার কিছু নেই। পিকচার তো অভি শুরু হুয়া হ্যায়।

এবার এগিয়ে আসবেন বেহালা চোদ্দো নম্বরে। ঢুকে যান বেঙ্গল হোটেলে। বেহালায় মিত্র ক্যাফে বা বসন্ত কেবিন নেই। আমাদের আছে বেঙ্গল হোটেল। এখানে এখনও ফিশ ফ্রাইয়ের কড়াইয়ে বাসা মাছ ওঠেনি। ফিশ ফ্রাই ফিশ ফিঙ্গার এখনও ভেটকি মাছের হয়। আর এখানে এখনও চিকেন কাটলেটকে ফাউল কাটলেট বলে ডাকা হয়। ছোট্ট কাঠের বেঞ্চ, চাকচিক্যহীন পেয়ালা পিরিচ, পুরনো দিনের বুড়ো রাধুনী জেঠু একটা শর্ট নর্থ কলকাতা ট্রিপ দিয়ে দেবে। ওখানের পেট পুজো শেষ হয়ে গেলে পাশের কচুরি র দোকানে ঢুকবেন। প্রচুর পুরনো দোকান। আর হিংয়ের কচুরিটা যা করে!! তার সাথে পাঁচ ফোড়ন দেওয়া খোসা সমেত আলুর তরকারি! আহা!

এবার রাস্তা ক্রস করে ঢুকে যাবেন শ্রী দুর্গা মিষ্টান্ন ভান্ডারে। আমি হলফ করে বলতে পারি শ্রী দুর্গার মত দই বড়া খুব কম জায়গাতেই পাওয়া যায়। ওখানের আরেকটা জিনিস চোখে জল এনে দেওয়ার মত ভালো। সেটা হলো এক রকম ক্ষীরের মিষ্টি, যেটা কলসের মত দেখতে, আর ভিতরে রস ভরা। নামটা ভুলে গেছি।

এবার আপনি এসে গেছেন ট্রাম ডিপো মোড়ে, বেহালা বাজারে। বাঁ দিকে ঢুকে গেলে ইলোরা সিনেমা হলের সামনে পাবেন বেশ অনেকগুলো চিনা খাবারের স্টল। এখানের চিকেন ললিপপ আর স্প্রিং রোল আমার পুজো বাজারের রুটিনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল।

এবার বেহালার শো স্টপারের কাছে যাওয়া। যারা কোনোদিন বেহালা আসেওনি তাঁরাও জানেন যেই জায়গার কথা। The famous হাজী সাহেবের বিরিয়ানির দোকান। বাজারের মুখে, পুরো চত্বর আলো করে আছে বিশাল বিশাল লাল শালু মোড়া বিরিয়ানির হাঁড়ি। বেহালা বাজার গেছেন কিন্তু হাজীর বিরিয়ানীর গন্ধে খিদে পেয়ে যায়নি? We do not do that here! বিরিয়ানি খেতে মিষ্টির খিদে পেয়েছে নিশ্চয়ই? পান্না to the rescue! পান্নায় অবশ্যই রসগোল্লা আর মালাই চমচম খাবেন। মিহিদানাও খাবেন। লালদই তো খাবেনই। আসলে সবই খাবেন। প্রত্যেকটা মিষ্টিই এক কথায় যাকে বলে লাজাওয়াব। ঠাণ্ডা কিছুর জন্য মন কাঁদছে? ঢুকে যান পান্না সুইটসের পাশেই পান্নার আইস ক্রিমের দোকানটায়। পকেট একটু আর্তনাদ করতে পারে। কিন্তু তাও ওদের বিভিন্ন স্বাদের আইস ক্রিম রোল চেখে দেখবেন। তারপর হাঁটতে শুরু করবেন deeper into বেহালা।

এসে গেছেন ম্যান্টন সুপারমার্কেটে। ঠিক উল্টো দিকে ইউনাইটেড ক্যাফে সাউথ ইন্ডিয়ান খাবারের দোকান। এইটা বেহালার সব থেকে পুরনো রেস্তোরাঁ। পঁচিশ বছরে আমি এখানের একটা প্লেটও চেঞ্জ হতে দেখিনি। ছোটবেলার স্কুল ছিল ইউনাইটেড ক্যাফের ঠিক পাশে। প্রায়ই বাবা স্কুল থেকে আনতে গিয়ে “চল সাউথ ইন্ডিয়ান পোলাও খাই” বলে আমাকে নিয়ে ঢুকে যেতেন ওখানে।

এবার অটো ধরতে হবে। অবশ্য এত গুরুপাক ভোজনের পর হাঁটাই ভালো। হেঁটে হেঁটে পৌঁছাবেন চৌরাস্তায়। বেহালাবাসিরা সবাই বলেন “আমি দাদার পাড়ায় থাকি।” বেহালা কিন্তু বিশাল বড়ো জায়গা আর দাদার বাড়ি চৌরাস্তায়। তাই পরের বার যখন কেউ বলবে “আমি দাদার প্রতিবেশী”, তীব্র প্রতিবাদ করে সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের মতে “প্রতিটা কথায় যে বাঁশির মত পো পো করে প্রতিবাদ করে সেই প্রতিবেশী” হয়ে যাবেন।

এসে গেছেন দাদার বাড়ির গলির মুখের শোভা প্রিয় রবীন্দ্রর সামনে। এখানে আর কিছু খান, না খান, রাবড়িটা মিস করবেন না। আর খাস্তা কচুরিও। এবার আসছে আমার সব থেকে প্রিয় জায়গা। বেহালা এসেছেন আর গোপীনাথের মিষ্টি খান নি? এতো ব্লাসফেমি!! প্রসঙ্গত, আমি মিষ্টি খুব একটা ভালোবাসি না। কিন্তু গোপীনাথে ঢুকলে আমি মিষ্টি খাই as if tomorrow doesn’t exist!

প্রথমেই বেকড রসগোল্লা খাবেন। একটা আনপপুলার অপিনিয়ন দেবো। মারবেন না প্লিজ। রাধারমন মল্লিকের বেকড রসগোল্লার থেকে গোপীনাথের আমার বেশি ভালো লাগে। রসগোল্লার পর খাবেন গোপীনাথ স্পেশাল butterscotch সন্দেশ। গোপীনাথের মিষ্টি আমার এত ভালো লাগে কারন কোনো মিষ্টিই তীব্র মিষ্টি না। একটা প্রচ্ছন্ন,সূক্ষ্ম মিষ্টত্ব। মুখে দিলেই গলে যাবে আর স্বাদটা লেগে থাকবে মুখে অনেক অনেকদিন। গোপীনাথের মিষ্টি খেয়েই মনে হয় আমির খুসরু লিখেছিলেন “গর ফিরদৌস বার রুয়ে জামিন আস্ত, হামিন আস্তো, হামিন আস্তো।”
আমাদের খাদ্য ভ্রমণ প্রায় শেষ। কিন্তু শেষ নাহি যে, শেষ কথা কে বলবে?

শীলপাড়ার দিকে আসুন। ঢুকে যান পাঞ্জাব হোটেলে। জায়গাটার চকচকে নাম নেই। এসি নেই। বেঞ্চ গুলো লড়ঝরে। কিন্তু ওখানের কাবাব অনেকদিন মুখে লেগে থাকবে আমি হলফ করে বলতে পারি। পকেটে চাপ লাগবে না কিন্তু মন অনেকটা ভরবে। চিকেন তন্দুরি আর হরিয়ালি কাবাব অবশ্যই খাবেন।

এভাবেই বেহালার খাওয়াদাওয়া শেষ। শীলপাড়া মোড়ের পানের দোকান থেকে পান চিবোতে চিবোতে এবার বাড়ি ফেরার পালা। বেহালা শুধুই জল আর মশা আর ট্রাফিক জ্যাম না। বেহালা আরও অনেক কিছু। বেহালা আমার শৈশব, আমার যৌবন, আমার খাদ্যপ্রেমের সূচনা। আশা করি ভয়ানক ট্রাফিক ঠেঙ্গিয়ে বেহালা আসা আপনাদের বৃথা হবেনা।

পুনশ্চ: জেমস লং, অর্থাৎ যেটাকে আমরা বাইপাস বলি, সেখানে গত পাঁচ ছয় বছরে প্রচুর রেস্তোরাঁ হয়েছে। বেশিরভাগই বিখ্যাত সব রেস্তোরাঁ চেইনের আউটলেট। আমি সেগুলোর কথা বললাম না। বললাম শুধু বেহালার speciality গুলোর কথা। এই রেস্তোরা গুলোও খুব ভালো এবং নামী। যথা, হাটারি, chowman, Domino’s, CCD, ইত্যাদি এবং বহু ছোটো ছোটো ক্যাফে। চাইলে এগুলোতেও ঢু মেরে আসতে পারেন। ক্যাফে গুলো বিশেষ করে খুবই মনোরম, যথা, ক্যাফে লাতে, ইগলু, beans and cream ইত্যাদি।