জেনে নিন ঠিক কি হয়েছিল বিশ্বের প্রথম মহাকাশচারী লাইকার সাথে?

মহাকাশে পাড়ি দেওয়া প্রথম প্রাণী কে? এই উত্তর আর কারোর কাছেই অজানা নয়। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন সেই বিখ্যাত কুকুর লাইকার কথাই বলছি। মহাকাশে পাড়ি দেওয়া প্রথম প্রাণী হিসেবে লাইকার নাম উঠলেও লাইকার আগে ১৯৪৮ সালে আ্যলবার্ট ওয়ান নামে একটি বাঁদর স্পেস ফ্লাইটে যাত্রা করেছিল। তবে এই যাত্রা ঠিক মহাকাশে পাড়ি দেওয়া ছিল না, তাই মহাকাশে পাড়ি দেওয়া প্রথম প্রাণী হিসেবে লাইকার নামই প্রথমে আসে।

লাইকার নাম সকলের জানা থাকলেও অনেকেই তাঁর সঠিক পরিচয় বিষয়ে অজ্ঞাতই থেকে যায়। লাইকাও কি ছিল অন্যান্য কুকুরদের মতো একজন সুখী কুকুর?

১৯৫০ সাল ও তার পূর্ববর্তী সময়ে মহাকাশে প্রাণীদের পাঠানো সহজ কাজ ছিল না বিজ্ঞানীদের পক্ষে, একটি চ্যালেঞ্জিং কাজ ছিল। ১৯৫৭ সালে রাশিয়ার মস্কোতে অন্যান্য কুকুরদের মতোই লাইকাও রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। তখন তাঁর বয়স ছিল ৩ বছর, সেই সময় কেউ জানতেও পারেনি যে লাইকাই হবে মহাকাশে পাড়ি দেওয়া বিশ্বের প্রথম প্রাণী। এইসময় রাশিয়ান বিজ্ঞানীদের সৃষ্টি বিশ্বের প্রথম উপগ্রহ স্পুটনিক-১ মহাকাশে পাড়ি দেয়। কিন্তু স্পুটনিক-১ এ ছিল না কোনও জীবিত প্রাণী। রাশিয়ান বিজ্ঞানীদের লক্ষ্য ছিল জীবিত প্রাণী সমের উপগ্রহ মহাকাশে পাঠানো। তাঁরা মাত্র চার সপ্তাহের মধ্যেই অন্য একটি উপগ্রহ তৈরি করেন। স্পুটনিক-২ নামক এই উপগ্রহটি খুবই ছোট ছিল, যাঁর ফল ভোগ করতে হয়েছিল লাইকাকে। উপগ্রহটি একটি কুকুরের থাকার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়েছিল। উপগ্রহটির ভিতরে কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করার একটি বস্তু, অক্সিজেন গ্যাস, কুকুরকে ঠান্ডা রাখার জন্য একটি ফ্যান ও ৭ দিনের খাবার রাখা ছিল। বিজ্ঞানীরা মহাকাশে পাঠানোর জন্য রাস্তার কুকুরদের নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন, কারণ অন্যান্য পোষা ককুরদের তুলনায় রাস্তার কুকুরদের সহ্যক্ষমতা বেশী। এরপর তাঁরা রাস্তা থেকে লাইকাকে খুঁজে বের করে এবং মহাকাশে পাড়ি দেওয়ায় উপযুক্ত করার জন্য তাঁকে বেশকিছু দিন ট্রেনিং দেন লাইকাকে। স্পুটনিক-২ এর কেবিনটি ছোট হওয়ার কারণে লাইকাকে ২০ দিন একটি ছোট কেবিনে বন্দি করে রেখে দেওয়া হয়, যাতে সে স্পুটনিকের ভিতর সহজে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে। সেই সময় মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার রাস্তা বিজ্ঞানীদের জানা থাকলেও সেখান থেকে ফেরার রাস্তা ছিল অজানা। তাই দেখতে গেলে মহাকাশে পাড়ি দেওয়ার সাথে সাথে লাইকা মৃত্যুর উদ্দেশ্যেও পাড়ি দিচ্ছিল। লাইকার কাছে অজানাই ছিল যে তাঁর জীবনের শেষ সময় ঘনিয়ে এসেছে। এক বিজ্ঞানী লাইকার শেষ সময়ে তাঁকে তাঁর বাচ্চাদের সাথে খেলার সুযোগ করে দেন। এরপর লাইকাকে স্পুটনিক-২ এর ভিতর তিনদিন ধরে বন্দি করে রেখে দেওয়া হয়, যাতে সে বেশী নড়াচড়া না করতে পারে। ৩রা নভেম্বর ১৯৫৭, স্পুটনিক-২ মহাকাশের উদ্দেশ্যে সফল ভাবে পাড়ি দেয়। পাড়ি দেওয়ার আগে একজন টেকনিশিয়ান লাইকার নাকে চুম্বন দিয়ে তাঁকে শেষবারের মতো বিদায় জানায়। লাইকাকে নিয়ে মহাকাশে সফল ভাবে পাড়ি দিলেও স্পুটনিক-২ এর কিছু টেকনিকাল ভুল ছিল। পাড়ি দেওয়ার সময় উপগ্রহটির একটি অংশ রকেট থেকে আলাদা হতে পারেনি। ফলে স্পুটনিকের ভিতরের তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। হয়ত মাত্র চার সপ্তাহ সময় একটি উপগ্রহ তৈরির জন্য যথেষ্ট ছিলনা। প্রচণ্ড গরমে লাইকার হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকে, তিন ঘন্টা ধরে মৃত্যুর সাথে লড়াই করে আরও দুঘন্টা বাদে মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত লাইকা সমেত স্পুটনিক-২ ১৬২ দিন সৌরজগতে ছিল, এবং ২০০০ বারেরও বেশী পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে।

যে জায়গায় লাইকাকে ট্রেনিং দেওয়া হয়েছিল সেখানে লাইকার স্মৃতির উদ্দেশ্যে লাইকার একটি মূর্তি স্থাপন করেন রাশিয়ান সরকার। লাইকার এই বলিদান মহাকাশ বিজ্ঞানের ইতিহাসে চিরকাল অমর হয়ে থাকবে।