জেনে নিন, একজন ‘মৃত’ ব্যক্তির ‘চূড়ান্ত মৃত্যু’ কখন হয়?

375

মৃত্যু নিয়ে আমাদের জ্ঞানের পরিধি খুব কম। এই নিয়ে এখনো আমাদের অনেক কিছু জানা বাকি।আপনি জানেন কী, একজন মানুষকে কখন ‘মৃত’ বলে ঘোষণা করা হয়? মূলত কোন মানুষের হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করলে, শ্বাসপ্রশ্বাস স্তব্ধ হয়ে গেলেই আমরা তাকে মৃত বলে মেনে নেই সকলেই।আর চিকিৎসকেরাও হৃদ্‌যন্ত্র, ফুসফুস ও মস্তিষ্কের ক্রিয়াকলাপ-সংক্রান্ত কিছু নির্ণায়ক বিবেচনায় নিয়ে রোগীকে মৃত ঘোষণা করেন।তবে কখন চূড়ান্ত বা সামগ্রিক মৃত্যু (সোমাটিক ডেথ) ঘটে, তার উত্তর দিতে পারেন না কেউই।

জীববিজ্ঞানের ভাষায় বলতে গেলে, মৃত্যুর কোনো সুনির্দিষ্ট একক মুহূর্ত নেই। মৃত্যুকালে মানুষ ধারাবাহিকভাবে ছোট ছোট মৃত্যুর ভেতর দিয়ে যায়। আলাদা আলাদা টিস্যু আলাদা আলাদা সময়ে মারা যায়। তবে এটা জানেন কী? একজন মানুষের মৃত্যুর ১০ মিনিট ও তারো বেশী সময় তার মস্তিষ্ক কার্যকর থাকে। কারণ তখন মৃত ব্যক্তির শ্বসনতন্ত্র এবং সংবহন তন্ত্র আর কাজ করে না। কারো শরীর অসাড় হয়ে গেলেও কিন্তু প্রাণ হাল ছাড়তে চায় না। ওই সময় হৃদযন্ত্র কাজ করা বন্ধ করলেও, মস্তিষ্ক সচল থাকে। শরীরের অংশগুলোর মধ্যে মস্তিষ্কই মূলত সবশেষে কাজ করা বন্ধ করে।একজন মানুষের মৃত্যুর কিছু সময় আগে মস্তিষ্কে বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রেরিত হয়। কেউ জানে না এটি কেন হয়? এরপর একসময় মস্তিষ্কে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। পরে তার শ্বাস-প্রশ্বাস এবং হৃদযন্ত্রের কার্যকালাপ বন্ধ হয়ে গেলেও, মানুষের ২-২০ সেকেণ্ডের মত জ্ঞান থাকে।

২০১৭ সালে নিউইয়র্ক শহরের এনওয়াইইউ ল্যাংগোন স্কুল অব মেডিসিনের ক্রিটিক্যাল কেয়ার অ্যান্ড রেসাসিটেশন রিসার্চ বিভাগের প্রধান স্যাম পারনিয়া এক গবেষণায় দাবি করেন, তাত্ত্বিকভাবে কোনো ব্যক্তিকে মৃত ঘোষণা করা হলেও একেবারে ফুরিয়ে যান না তিনি। তার চেতনা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত সজাগ থাকে এবং তিনি অন্যের কথা শুনতে পান। কিন্তু তার কিছু করার মতো শক্তি বা সামর্থ্য থাকে না।

তবে মৃত্যুর পরও মানুষের জ্ঞান থাকার পেছনের কারণ, সেরেব্রাল কর্টেক্স। এটি অক্সিজেন ছাড়াও কাজ করতে পারে। এছাড়াও মস্তিষ্কের এই অংশটি চিন্তা ভাবনা এবং কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। এটি আমাদের স্নায়ু থেকে তথ্য নিয়ে কাজ করার নির্দেশ পাঠায়। সেরেব্রাল কর্টেক্স কাজ করা সত্ত্বেও, মৃত্যুর পূর্বে শরীর আত্মবাচক এবং পেশীসংক্রান্ত ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। আস্তে আস্তে মস্তিষ্কের কাজ করার ক্ষমতা হ্রাস পায়। মস্তিষ্কের কোষগুলো রাসায়নিক কিছু কাজ করা শুরু করে যা তাদের মৃত্যুর দিকে নিয়ে যায়।

আমরা মূলত বেঁচে থাকি অক্সিজেনের কারণে। এটি মানুষের বেঁচে থাকা এবং মৃত্যুর মধ্যে সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। যদি কেউ সিপিআর বা লাইফ সাপোর্টের মাধ্যমে হৃদযন্ত্রকে আবার সচল করে তুলতে পারে, তাহলে মস্তিষ্ক আবার সচল হওয়ার জন্য যথেষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন পায়। মোদ্দাকথা অক্সিজেন না পেলে মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এরপর আস্তে আস্তে ওই মানুষ মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে যায়।

এদিকে, একজন মৃত মানুষ অক্সিজেন হারিয়ে ফেললে যেভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে ঠিক তেমনি একজন ডাক্তার লাইফ সাপোর্ট সরিয়ে নিয়ে ওই রোগীকে ক্লিনিকালি মৃত ঘোষণা করেন। কিন্তু মস্তিষ্ক মৃত্যুর পর ও ১০ মিনিটেরও বেশি সময় পর্যন্ত সচল থাকে। প্রত্যেক মৃত ব্যক্তির ইলেক্ট্রো এনসেফালোগ্রাফিক বা ইইজি রেকর্ড চেক করলে দেখা যায়, প্রত্যেকের রেকর্ড ই আলাদা। এর অর্থ একেক মানুষের মৃত্যুর সময় ভিন্ন ভিন্ন রকম অভিজ্ঞতা রেখে যায়।

আরো অবাক হবেন, একজন মানুষের মৃত্যুর দুইদিন পরও শরীরের ১০০০ এরও বেশি জিন কাজ করতে থাকে। এদের মধ্যে কিছু জিন খুব জোরালোভাবে কাজ করে থাকে এবং এগুলো খুব গুরুত্বপূর্ণ যেমন, প্রদাহ উদ্দীপনা, রোগ প্রতিরোধক ব্যবস্থাপনায় ইন্ধন জোগানো এবং পাল্টা দুশ্চিন্তা ইত্যাদি কাজ করতে থাকে। কিন্তু কিছু কিছু জিন কেবল ভ্রূণাবস্থায় কাজ করে। আবার এও দেখা যায়, কিছু কিছু জিন ওইসময় ক্যান্সার কোষ বৃদ্ধি করতে থাকে।

মূলত শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে সৈন্য, কসাই এবং জল্লাদেরাও দেখেছেন, শিরশ্ছেদ দ্বিখণ্ডিত করার পরও শরীরের বিভিন্ন অংশ আপনা-আপনিই কাঁপছে। লাইফ সাপোর্ট আবিষ্কারের অনেক আগে ঊনবিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসকেরা শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ার কয়েক ঘণ্টা পরও হৃৎস্পন্দন চালু রয়েছে- এমন অনেক রোগী পেয়েছেন।

এতে প্রতীয়মান হয় যে, একজন মানুষ মৃত্যুর আরো কিছু সময় পর্যন্ত তার মস্তিষ্ক ও শারীরিক নানা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সচল থাকে। তবে সেটিও একেকজনের একেক সময় পর্যন্ত হতে পারে।