‘যশ’ মনে করিয়ে দিল, টাইফুনের ছোবল থেকে বেঁচে আসার কাহিনী

148

রুণ কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ আমি জীবনের বেশীর ভাগ সময় সমুদ্রের বুকেই কাটিয়েছি , মাঝ সমুদ্রের সব রকম ঝড়ই বেশী দেখেছি। পাড়ের কাছের ঝড় দেখার অভিজ্ঞতা ও কয়েকটা হয়েছে । তবে একবার ১৯৮৬ সনে তাইওয়ানের কিলুং বন্দরে মারাত্মক একটা সুপার টাইফুনের পাল্লায় পড়ে, যে অভিজ্ঞতা হয়ে ছিল। তা সারা জীবনেও ভুলতে পারব না। আমরা ওই বন্দরে জাহাজে বস্তা বস্তা চাল বোঝাই করছিলাম । হঠাৎ একদিন বন্দর কর্তৃপক্ষ আমাদের জনাল যে একটা টাইফুন ঘূর্ণিঝড় আমাদের দিকে ধেয়ে আসছে । তাই জাহাজে মাল বোঝাই এর কাজ আপাতত বন্ধ রাখতে হবে। এই প্রসঙ্গে আজকের আজকের আলোচনা।

প্রথমেই তুলে ধরা যাক, নীম্নচাপ কি?

চাপের যদি নীম্ন বলে কিছু থাকে, তাহলে উর্ধ বলেও কিছু আছে নিশ্চই ? জল যেমন গড়ায় উপর থেকে নীচে, হাওয়াও তেমনি বয় উর্ধ চাপ থেকে নীম্ন চাপে। চাপ কি? বায়ু স্তরের চাপ, মাপা হয় ব্যারোমিটার দিয়ে। নীম্ন চাপ কি? স্ট্যান্ডার্ড চাপের থেকে বা স্বাভাবিকের থেকে নীম্ন হলেই তাকে নীম্ন চাপ বলা হবে। স্বাভাবিক কি ? আবহাওয়া দফতর থেকে সারা পৃথিবীর সব অঞ্চলের মাসিক স্বাভাবিক বায়ু চাপ ও তাপ মাত্রার একটা তালিকা তৈরি করেছেন ।সেটাই স্বাভাবিক । তবে সব নীম্ন চাপই কিন্তু ঝড় বা ঘূর্ণি ঝড়ে পরিণত হয় না। কেন হয় না? কারন ঘূর্ণি ঝড় হতে গেলে তার কেন্দ্র বিন্দুকে কেন্দ্র করে চক্রাকারে নীম্ন চাপ থাকবে। কেন্দ্রটিতে সর্ব নীম্ন থাকলেও তাকে ঘিরে চক্রাকারে নীম্ন চাপ রেখা থাকবে। ঝড় মাত্রই মারাত্মক হলেও ঘূর্ণি ঝড় কিন্তু সব থেকে মারাত্মক। মাঝ সমুদ্রে ও মারাত্মক, কিনারা বা স্থলভূমিতেও মারাত্মক। এই মারাত্মক হওয়ার প্রধান কারণ ঘূর্ণি ঝড়ের চরিত্র । এক তো এর হাওয়ার গতিবেগ অন্য ঝড়ের থেকে বেশী হয়, তারপর সেই ভয়ঙ্কর গতিবেগ সম্পন্ন হাওয়া একটা বিশাল জায়গা নিয়ে ক্রমাগত চক্রাকারে ঘুরতে থাকে । অন্য ঝড়ে বড়ো বড়ো গাছের ডাল পালা ভাঙ্গতে পারে। কিন্তু ঘূর্ণি ঝড় তাকে সমূল মাটি থেকে উপড়ে ফেলতে পারে। ঘূর্ণি ঝড়ের একটা কেন্দ্র বিন্দু থাকে । সেই জায়গাটা নিঃসন্দেহে সবথেকে মারাত্মক। কিন্তু সেই কেন্দ্র বিন্দু থেকে হাজার হাজার মাইল দূরেও ঝড়ের তাণ্ডব চলতে পারে। তবে সেই তান্ডবের মাত্রার তারতম্য থাকবে। শুধু তাই নয় কেন্দ্র থেকে দূরত্ব অনুযায়ী আবহাওয়ার তারতম্য হবে। কোথাও বজ্র বিদ্যুৎ সহ ভারী বৃষ্টি হবে। কোথাও হালকা থেকে মাঝারী বৃষ্টি পাত হবে।

এবার বলা যাক কিলুং বন্দরের ঘটনাঃ

কোথাও কিছু নেই ঝড় আসার তিন দিন আগে বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের কাজকর্ম বন্ধ করে দিতে আমরা পড়লাম বিপদে। জাহাজে নিষ্কর্মা হয়ে বসে থাকলে সময় কাটে না। সেটাও এক ধরনের লক ডাউন। এদিকে শুধু জাহাজে বা বন্দরেই নয় পুরো শহরে কাজকর্ম বন্ধ হয়ে গেছে। সমস্ত অফিসে স্কুলে কলেজে ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে । দোকান পাট হাট বাজার বন্ধ হয়ে গেছে। রাস্তায় লোক বা গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সকাল থেকে টিভি আর রেডিওয় সমানে ঝড়ের বুলেটিন প্রচার করা হচ্ছে। আর সাবধান বানী হিসাবে বলা হচ্ছে- বাড়ি থেকে একদম বের হবেন না। জানালা বারান্ডা বা ছাদে , উড়ে যেতে পারে এমন কোন জিনিস রাখবেন না। ফ্রিজে ও বাড়িতে পর্যাপ্ত পানিয় জল দুধ ও খাবার মজুত করে রাখুন। বড়ো বড়ো বাড়িতে লিফট ব্যবহার করবেন না। ঝড় এসে পড়লে কারেন্ট চলে গিয়ে ব্ল্যাক আউট হয়ে যেতে পারে। তার জন্য মোমবাতি দেশলাই টর্চ প্রস্তুত রাখবেন। কিন্তু জাহাজে বসে বসে এসব শুনতে কতক্ষণ ভালো লাগে? আমরা কজন জাহাজ থেকে বেরিয়ে ছিলাম। কারন মূল ঝড় আসতে তো এখনো তিন দিন বাকি। কিন্তু জাহাজ থেকে নামা মাত্র বন্দর পুলিশ আমাদের আটকাল। এবং জাহাজে ফিরে যেতে বলল । তারপর আর কি খেয়ে বসে টিভি দেখে আর রেডিও শুনেই আমাদের সময় কাটাতে হ’ল। কিন্তু মূল ঝড়টা যেদিন রাত্রে জাহাজের উপর আছড়ে পড়ল , আমি একা সে রাত্রে নাইট ডিউটিতে ছিলাম। খাঁড়ির ভিতরে সমুদ্রের জল ঝড়ের দাপটে বাসুকি সাপের ফনার মতো দশ পনের ফুট লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছিল । বন্দরের গায়ে বাঁধা অবস্থায় ও জাহাজটা মোচার খোলার মতো দুলছিল। আমার প্রতি মুহূর্তে ভয় করছিল যে এই বুঝি জাহাজের সব দড়ি দড়া ছিঁড়ে সে ভেসে বেরিয়ে যায়। সবথেকে ভয়াবহ ছিল কাঁচের জানালার উপর ঝড়ের দাপটে গোঁ গোঁ শব্দ। সে গুলোও মনে হচ্ছিল যে এই বুঝি ভেঙ্গে পড়ে। মাঝ রাতে এক সময় আমি জাহাজের গ্যালি বা বড়ো রান্না ঘরটায় ঢুকে ছিলাম কিছু খাবারের সন্ধানে । রান্না ঘরের সমুদ্রের দিকের কাঁচের জানালার ওপর ঝড়ের এমন গোঁ গোঁ আওয়াজ উত্তর উত্তর বাড়ছিল যে এক সময় আমার মনে হয়েছিল যে জানালাটা ভেঙ্গে পড়বে। আমি কানে আঙ্গুল দিয়ে সটান মেঝেতে শুয়ে পড়ে ছিলাম। এই তাণ্ডব সারা রাত্রি ধরে চলেছিল।সব থেকে ভয়াবহ ছিল, আমাকে একা এই ঘটনার সাক্ষী থাকতে হয়েছিল । আর একজনও কেউ তাদের কেবিন থেকে বের হয়নি । তাই সেই সময় আমি কারো সাথে আমার ভয় শেয়ার করতে পারিনি। তাও পরে শুনেছিলাম যে মূল ঝড়টা নাকি জাহাজ থেকে পঞ্চাশ মাইল দূর দিয়ে গেছে। ঝড় চলে যাবার পরে আমরা জাহাজের খোলে দেখি জল ভরে গেছে। সেই জল পাম্প করে বের করতে হ’ল। অনেক বস্তা চাল ও জলে ভিজে খারাপ হয়ে গিয়েছিল। তবে আমারা বেঁচে গিয়েছিলাম।