বিরোধী দল থাকাকালিন বিজেপির কাছে সিবিআই ছিল ‘কংগ্রেস ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন’

বিশিষ্ট সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষালের কলম এই প্রথমবার ইন্ডিপেন্ডেন্ট ২৪x৭ এর সম্পাদকীয় বিভাগে

150

য়ন্ত ঘোষালঃ বিজেপি যখন সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে প্রধান বিরোধী দল ছিল তখন সিবিআই – এর নাম দিয়েছিল কংগ্রেস ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (Congress Bureau of Investigation) । এই ব‍্যাপারে আমি তৎকালীন বিজেপির মতামতের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। সেটা হল, ৪৭ সালে নেহেরু ক্ষমতার আসার পর কংগ্রেসের দীর্ঘ শাসন আমরা দেখেছি। সিবিআই এর জন্ম নেহেরু র সময় ! কিন্তু ইন্দিরা জমানায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব‍্যবহার করার স‌ংস্কৃতি তৈরি হয়। তিনি স্বয়ং করেন। এরপর সিবিআই অনেক রূপান্তরের মধ্যে দিয়ে গেছে। কিন্তু সিবিআই, যে এতো মামলা করেছে কটা মামলায়, রাজনৈতিক নেতা অনেকে গ্ৰেপ্তার হয়েছে কিন্তু তাঁদের দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়েছে তার দৃষ্টান্ত খুবই কম। বিহারের লালুপ্রসাদ যাদবের ক্ষেত্রে হয়েছে বটে, কিন্তু সেটা আদালতের নির্দেশে হয়েছে। তিনিও জামিন পেয়ে গেছেন। কিন্তু দোষ প্রমাণ হয়েছে, সেই দোষের শাস্তি হিসেবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে এমন দৃষ্টান্ত আমার তো মনে পড়ছে না ! ২জি র তদন্ত আজ ও শেষ হয়নি !

সিবিআইয়ের কোর্টে বিচারের ফলে শুধু লালু নয়, বিহারের আরো কিছু নেতারও শাস্তি হয়েছে বটে কিন্তু সকলেই জামিন পেয়েছেন। আজও সম্পূর্ণ প্রমাণ হয়নি, উল্টে কংগ্রেস জমানায় সিবিআই অমিত শাহকে জেলে পুরেছিল। কিন্তু তিনিও সুপ্রিমকোর্টে বেকসুর খালাস পেয়ে গেছেন। অর্থাৎ অমিত শাহের বিরুদ্ধে অভিযোগ আজ আর প্রমাণিত অভিযোগ নয়। যোগিন্দর সিং সিবিআই-এর প্রধান ছিলেন। তিনি তার বইতে লিখে গেছেন, বোফর্স নিয়ে কিভাবে তার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, এবং তৎকালীন সরকার সেই চাপ সৃষ্টি করেছিল। মূলত দেবেগৌড়া কংগ্রেসের সমর্থন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়ে ছিলেন। তিনি কর্ণাটকের মানুষ ছিলেন। যোগিন্দর পাঞ্জাবি সর্দারজী হলেও কর্ণাটকের কাডার ছিলেন। তিনি লিখেছেন, যে দেবেগৌড়া তাকে সেভাবে কোনো বাধা না দিলেও, দেবেগৌড়াকে সড়িয়ে দেওয়া হল, এবং তার বদলে ইন্দরকুমার গুজরাল প্রধানমন্ত্রী হলেন। সেই পরিবর্তনের পেছনেও ছিল বোফর্স কেলেঙ্কারির তদন্ত। দেবেগৌড়ার চলে যাওয়ার পরে সেই তদন্ত করতে দিতে তাকে পদে পদে বাধা দেওয়া হয়। যার ফলে এই তদন্ত টার আর কিছুতেই কিছু হল না। ইন্দরকুমার গুজরালের আত্মজীবনীতেও আছে, যে সীতারাম কেশরী তার সঙ্গে প্রাতঃরাস করতে এসে জানিয়েছিলেন, বোফর্স নিয়ে পিছু হটতে হবে তেমনটাই সনিয়া গান্ধী চাইছেন। যদি তিনি পিছু না হটেন তবে তাকেও ক্ষমতাচ্যুত করা হবে। এবং পরবর্তীকালে আমরা জানি ইন্দরকুমার গুজরাল কেও ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছিল‌। সুতরাং এইসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত চরিত্ররাই বইতে এগুলো লিখে গেছেন। কিন্তু কংগ্রেসের পর, বিজেপি যখন ২০১৪ সালে বিপুল সংখ‍্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে এলো তখন সাধারণ মানুষের আশা ছিল, সিবিআই নামক এই যে প্রতিষ্ঠানটি যার এতো potentiality আছে। সেই প্রতিষ্ঠানটাকে অন্তত কিছুটা উন্নতমানের দিকে নিয়ে যাওয়া হতে পারে। কিন্তু বাস্তবে কী সেটা হয়েছে ? হয়নি। অতীতেও যেভাবে সিবিআই বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে, সেভাবেই সিবিআইকে সরকারের তোতাপাখিতে পরিণত করা হয়েছে, যেটা সুপ্রিমকোর্ট বলেছে। সেভাবেই কিন্তু সিবিআই আজ কাজ করছে। এবং সাম্প্রতিকতম পশ্চিমবঙ্গে দৃষ্টান্ত হচ্ছে এই ‘নারোদা কেলেঙ্কারি’- এর তদন্ত। মনে রাখতে হবে, নারদা কেলেঙ্কারির যে অভিযোগ আদালতে প্রথম পেশ হয়, সেটা কিন্তু বিজেপি করেনি। সেটা কংগ্রেস এবং সিপিএম যৌথভাবে করেছিল। আরও মজার ব‍্যাপার আইনজীবী হিসেবে কপিল সিব্বল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ নিয়েছিল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এর পক্ষ নিয়েছিল। যদিও বিরোধী দলনেতা হিসেবে কংগ্রস এবং সিপিএম যৌথভাবে চিটফান্ড থেকে শুরু করে নারোদা এই সমস্ত কেলেঙ্কারির অভিযোগ করেছিল। তার ভিত্তিতেই সিবিআই তদন্তটা করেছে। এখন সিবিআই নারদা কেলেঙ্কারির ব‍্যাপারে গ্ৰেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে যেভাবে আক্রমণাত্মক ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, এটা নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহের অঙ্গুলি হেলনে হচ্ছে বলেই কিন্তু সাধারণ মানুষের ধারণা।

রাজ‍্যসভার সদস্য ছিলেন কে.ডি.সিং। তিনি তৃণমূলেরও সাংসদ ছিলেন। কিন্তু বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রক্ষা করতেন। তার নিজের অ্যালকেমিস্ট- নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চিট ফান্ড কেলেঙ্কারি হয়েছিল। তিনি হাউসিংও চিঠফান্ডের মতো টাকা তোলেন বলে অভিযোগ ওঠে, তদন্ত হয়। তাকে গ্ৰেপ্তার করা হয়। কিন্তু এটাও জেরা করে জানা গেছে, যে নারোদার স্টিং অপারেশন করা সেই ম‍্যাথু স‍্যামুয়েল জানিয়েছেন, প্রজেক্টটা করার জন্য কে.ডি. সিং তাকে কোটি কোটি টাকা দিয়েছেন। সেক্ষেত্রেও কে.ডি.সিং কে তেহেলকা নামক যে সংস্থা হায়ার করেছিল, সেটা কার কথায় করেছিল, এটাই এখন তদন্তের বিষয়। এর পেছনে কী বিজেপি ছিল ? এর পেছনে কী তৃণমূলের কোনো নেতা ছিল ? এইসব নিয়ে নানান প্রশ্ন আছে। এটা খুব পরীষ্কার, যে এটার মধ্যে একটা রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের ছিল। বিজেপিতে এখন শুভেন্দু অধিকারী এবং মুকুল রায় এসে গেছে। কিন্তু ম‍্যাথু কিন্তু বলেছেন, মুকুলকে টাকা নিতে দেখা যায়নি। জানিয়েছিল, যে টাকাটা কাকে দিতে হবে। যাকে দিতে হবে জানিয়েছিল তাকে ইতিমধ্যে গ্ৰেপ্তারও করা হয়েছে। সেই পুলিশের অফিসারকে সিবিআই আগেই গ্ৰেপ্তার করেছে। কিন্তু শুভেন্দু অধিকারীর ক্ষেত্রে তো সরাসরি টিভির পর্দায় টাকা নেওয়ার ফুটেজ দেখা গেছে। তাহলে তাকে এই তালিকা থেকে কেন বাদ দেওয়া হবে ? সেক্ষেত্রে যদি অন‍্য কোনো এমপিদের বাদ দেওয়া না হয়, তবে তার বিরুদ্ধেও ব‍্যবস্থা গ্ৰহন করাটা সিবিআই -এর কর্তব্য। সুতরাং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তোতাপাখির মতো সিবিআই- এর এই আচরণ এটা সুপ্রিমকোর্ট নিজেরাই জানিয়েছে। সিবিআই এমন একটা প্রতিষ্ঠান, যেখানে এতো মামলা, সেখানকার যেকোনো অফিসারের সঙ্গেই কথা বললে জানতে পারবেন, তারা কিন্তু বলছেন তাদের ওপরে এই মামলা চাপিয়ে দেওয়া হয়। সাধারণত নিয়ম হচ্ছে, যে আদালত যদি নির্দেশ দেয়, যদি বিধানসভা বা সংসদে কোনো ঐক‍্যমত‍্য তৈরি হয় যেটাতে সিবিআই করতে হবে। তখনই সাধারণত সিবিআই তদন্তটা করে। তবে বহু ক্ষেত্রে তারা ‘সুয়োমোটো’ অর্থাৎ স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে সিবিআই কোনো একটা তদন্ত করতে পারে। এটা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক বা কোনো একটা সরকারের সুপারিশে, এমনকি সিবিআই এর নিজেদেরই যদি মনে হয়, এটা তদন্ত হওয়া উচিত, তাহলে সেটার তদন্ত করার অধিকারও সিবিআই এর আছে। কিন্তু এখন সিবিআই সত্যি সত্যি একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা কিনা সেটা নিয়েই প্রশ্ন উঠেছে ! তাদের সমস্ত কার্যকলাপ এইভাবে মিডিয়া ট্রায়ালের মাধ্যমে হবে কেন ? সেই গোপনীয়তাটা যদি তারা রক্ষা করতে না পারে তাহলে আর তাদের কার্যপদ্ধতিটা নিয়েই তো প্রশ্ন ওঠে। কারণ এদের তদন্তের জন্য তো গোপনীয়তাটা বিশেষ ভাবে জরুরি। সেই গোপনীয়তাকে মিথ্যে করে দিয়ে যেভাবে সিবিআই খবরের কাগজ বা সংবাদমাধ্যমে এর থেকে সাহায্য নিয়ে এক একটা গ্ৰেপ্তার বা এক একটা তল্লাশি অভিযানকে টেলিভিশনের পর্দায় আনার অনুমতি দিয়ে, সেটাকে দেখানোর ব‍্যবস্থা করে যেভাবে একটা Event of the day – তৈরি করা হচ্ছে। তার ফলে গোটা দেশে সেটাকে নিয়ে একটা রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। এটা সিবিআই এর Style of function ছিল না। তাহলে কেন তারা এরকম ভাবে করছে ! এও কী একধরনের Mediatized democracy এর নমুনা ?

সিবিআই-এর জন্মলগ্ন থেকেই বিতর্ক শুরু হয়েছে। সিবিআই অর্থাৎ এই যে ব‍্যুরোটা এটার জন্ম Special police establishment act 1941. যেটার ভিত্তিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি হয়েছিল। এটা তার মানে ১৯৪১ এর প্রাক্ স্বাধীনতা আইন থেকেই উৎসারিত। এটা পুনর্গঠিত হয়েছিল Delhi special police establishment act 1946 অনুসারে। ‘সিবিআই’ এই কথাটার জন্ম হয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকারের একটা সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ১৯৬৩ সালের ১লা এপ্রিল। সেই Resolution no. হল 4/31/61-T-MHA. সেই দিন থেকে এটি একজন ডিরেক্টর বা অধিকর্তার অধীনে আসে। সেই সময় যিনি আইজি ছিলেন ডি.পি.কোহলি। তিনি প্রথম অধিকর্তা হিসেবে সিবিআই এর কাজ শুরু করেন। তিনি দশ বছর এই পদে ছিলেন। সেই সময় স্বরাষ্ট্র সচিব ছিলেন এল.পি.সিং। তিনি একজন আইসিএস অফিসার ছিলেন। ডি.পি.কোহলি এবং এই এল.পি.সিং তারা দুজনে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। নেহেরু ১৯৬৪ সালে মারা যান। লালবাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গেও কিন্তু এর দুজনে খুব সক্রিয়ভাবে কাজ শুরু করেছিলেন। ‘সানথানাম’ কমিটির দুর্নীতি দমনে সুপারিশ ছিল। সেটার ভিত্তিতে নানান রকমের দুর্নীতির তদন্ত শুরু করা। এটাই ছিল সিবিআই এর হাতেখড়ি। এই ব‍্যাপারে সেই সময় মানুষের আশা-প্রত‍্যাশা অনেক বেশি ছিল। সেটা সিবিআই পালন করতে শুরু করে। কিন্তু এই আইনের যে বিচ‍্যুতি সেটা পরবর্তী কালে সাংঘাতিক ভাবে শুরু হয়ে যায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক যুগে এটাকে নানান রকমভাবে ব‍্যবহার করা হয়েছে। আমরাও তো দেখেছি ইন্দিরা গান্ধীকে পর্যন্ত সিবিআই রীতিমতো ইন্টারপোলের সাহায্য নিয়ে গ্ৰেপ্তার করেছিল। তাঁর বাড়িতে সিবিআই এর কর্তারা পুলিশ নিয়ে হাজির হয়। সেই ঘটনার সময়ও কিন্তু আকস্মিকতা ছিল। পরিবারের যারা অন‍্যান‍্য সদস্যরা সেই সময় হাজির হয়ে বিক্ষোভ দেখান।সেই সময় কংগ্রেসের প্রচুর কর্মী ইন্দিরা গান্ধীর বাড়ির সামনে এসে সিবিআই এর বিরুদ্ধে বিরাট ভাবে বিক্ষোভ দেখিয়ে ছিল।

ইন্দিরা গান্ধীকে গ্ৰেপ্তার করা হয়েছিল ১৯৭৭ সালের ৩ অক্টোবর। এটা সিবিআই করেছিল। গোটা দেশে এই গ্ৰেপ্তারকে নিয়ে হইহই পড়ে গেছিল। ‘৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতাচ্যুত হয়ে মুরারজী দেশাই সরকার তৈরি হয়েছিল। সিবিআই এর প্রাক্তণ প্রবীণ অফিসার এন.কে.সিং ‘The Whole Truth CBI Top Cop Speaks’ – এই বইটাতে সেই গ্ৰেপ্তারের ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যে কদিন আগেই তিনি সবে বিদেশ থেকে এসেছেন। সদর দপ্তর থেকে তার কাছে নির্দেশ এল, সিবিআই এর সদর দপ্তরে এসে যুগ্মঅধিকর্তা ভি.আর.লক্ষীনারায়ণের সঙ্গে বৈঠক করতে, যাতে পরেরদিন সন্ধ্যে বেলায় গ্ৰেপ্তার করা যায় তার একটা এনটায়ার প্ল‍্যান তৈরি করার জন্য তাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই অ্যারেস্ট এর কাজটা তাকেই করতে হবে। সিবিআই টিম ১২ নং উইলিংটনক্রিশেন্টে গেল, যেখানে তখন ইন্দিরা গান্ধী থাকতেন। উনি লিখছেন, যে আমার নেতৃত্বেই একটা টিম গেল। আমার সঙ্গে একজন ডিএসপি এম.ভি.রাও ছিলেন। একজন ইনস্পেকটর এন.এন.সিং ছিলেন। একজন বা দুজন কনস্টেবল ছিল। আমরা সাধারণ পোশাকে ছিলাম। কারণ আমরা সিবিআই। আমরা সেখানে দুটো অ্যাম্বাসাডার গাড়ি করে পৌঁছে ছিলাম। নির্দেশ মতো আমরা দিল্লি পুলিশকেও গেটের বাইরে পজিশন নিয়ে নিতে বলেছিলাম, যাতে বাইরে থেকে কোনো লোককে ভেতরে ঢুকতে দেওয়া না হয়। সেখানে দিল্লি পুলিশের সাহায্য নিয়ে ভেতরে ঢুকে গিয়ে তাঁকে গ্ৰেপ্তার করলাম। দিল্লি পুলিশ আমাদেরকে একটা পাইলট ভ‍্যান দিল। যাতে সেখান থেকে আমরা বাতখাল লেকে হরিয়ানায় টুরিস্ট রির্সোট ছিল, সেখানে যাতে ইন্দিরা গান্ধীকে একটা রাত্রি রাখতে পারি। তাঁকে জেলে না পুরে একটা গেস্টহাউসে রাখা হল। তাঁর সঙ্গে দুঘন্টা তর্ক-বিতর্ক হল। উনি লিখছেন, যে তারপর দেখলাম সঞ্জয় গান্ধীর নেতৃত্বে প্রচণ্ড ভীড় হয়েছিল। প্রচণ্ড বিক্ষোভ দেখিয়েছিল। সেখানে তারা গাড়ির ওপর চড়াও হয়ে ভাঙচুর করেছিল, রাস্তা ব্লক করে দিয়েছিল। নির্মলা দেশপান্ডে ওনার সঙ্গে থাকবেন এটাতে আমরা রাজি হয়েছিলাম। কিন্তু পরে সে ঢুকলে গোলমাল শুরু হয়। পরেরদিন আমরা চিফ মেট্রোপলিটনের আদালতে তাঁকে পেশ করি। দেখলাম যে ম‍্যাজিস্টেট খুব টেনশনে আছেন। বেশ ঘনঘন নিশ্বাস নিচ্ছেন কী করবেন বুঝতে পারছেন না ! কেননা, আফটারঅল এটা ইন্দিরা গান্ধী। তিনি নিজে উঠে দাঁড়িয়েছেন, অভিযুক্ত হিসেবে কথা বলছেন। কদিন আগেও তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, একদিন-দুদিন নয়, এগারো বছর ধরে। তাঁকে এরকম খারাপভাবে যে আদালতে আসতে হয়েছে, সেটা নিয়ে জনমানষে একটা খুব তীব্র প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। প্রণব মুখোপাধ্যায় এবং বসন্ত শাটে আদালতে এসে হাজির হন। তখন প্রবল গোলমাল শুরু হয়ে গেছিল।

একটা জিনিস মনে রাখতে হবে, যে এই গ্ৰেপ্তারের কারণটি কী ছিল ? সেটা ছিল একটা জীপ স্ক‍্যান্ডেল কেস। এই কেসটার তদন্ত করতে ইন্টারপোলের সাহায্য নিয়ে পশ্চিম জার্মানিতে গিয়ে পর্যন্ত তদন্ত করতে হয়েছিল। সেখানে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের জীপ কেনা-বেচার দুর্নীতির অভিযোগে তদন্ত হয়েছিল। গোটা দেশ জুড়ে এরপরে আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। কিন্তু সেটা ইন্দিরা গান্ধীর বিপক্ষে যায় নি, পক্ষেই যায়। সিবিআই এর এই ট্রাডিশনটাকে ইন্দিরা গান্ধী যখন জরুরি অবস্থার পর আবার ক্ষমতায় আসলে তখন সেই সিবিআই কেই আবার নক্কারজনক ভাবে ব‍্যবহার করা শুরু হল। এই বইটির লেখক এন.কে.সিং কেও সিবিআই গ্ৰেপ্তার করলো। তিনি ‘কিস্সা কুর্সি কা’ নামে সঞ্জয় গান্ধীর বিরুদ্ধে একটা মামলার তদন্ত করছিলেন। সময় যখন বদলে যায়, যখন ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতায় আসেন তখন কিন্তু গুরগাঁও পুলিশকে দিয়ে এই এন.কে.সিং কে পাল্টা গ্ৰেপ্তার করা হয়েছিল। সুতরাং এই বদলার মানসিকতাটা সিবিআই এর নতুন নয়। বারবার এইরকম ঘটনা ঘটেছে। সেটা এম.নারায়ণণ, তিনি সিবিআই এর যুগ্ম অধিকর্তা ছিলেন। তাঁর লেখা বই ‘Voice Of CBI’ তে লিখেছেন, তিনি কিন্তু সাব-ইন্সপেক্টর হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি কেরলের মানুষ। ওনার বইতে একটি চ‍্যাপটার ই আছে ‘গ্ৰেপ্তার’। সেখানে তিনি দেখিয়েছেন, সিবিআই এর গ্ৰেপ্তারি নিয়ে কতখানি সংবেদনশীল বিষয়। এটা শুধুমাত্র আইনের একটা ধারা, যে ধারা বলে সিবিআই এর পাওয়ার আছে, সুতরাং আমি গ্ৰেপ্তার করলাম ব‍্যাপারটা কিন্তু তা নয়। মানুষ সেটাকে কিভাবে গ্ৰহন করছে, সেই পারসেপশনও কিন্তু মাথায় রাখতে হয়। কেননা, এই গ্ৰেপ্তার গুলো যদি গোপন না থাকে, যেহেতু গণতন্ত্রের একটা প্রকাশ‍্য দিক থাকে। সুতরাং সেই কথাটা মাথায় রেখেও কিন্তু সিবিআই কে এগোতে হয়। ওনার বই এর ১০ নম্বর একটা অধ‍্যায় আছে। অধ‍্যায়টার নামই হচ্ছে ‘Criticism Of CBI’ — সেখানে সিবিআই তে কীভাবে দুর্নীতি হয়, সিবিআই তে কীভাবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ হয় সেসব কথাও রয়েছে। ‘গ্ৰেপ্তার’ বলে যে পৃথক চ‍্যাপটার, সেখানে এটাই বলার চেষ্টা করেছেন, শুধু ভারতীয় দন্ডবিধির Section-41 এর প্রয়োগ নয়। সেই আইন অনুযায়ী তো সিবিআই অনেক কিছুই করতে পারে। কিন্তু চার্জশিটটা কতটা শক্তপোক্ত এবং চার্জশিট ছাড়া গ্ৰেপ্তার করা অনুচিত। চার্জশিটটা সঙ্গে সঙ্গে আদালতে পেশ করলেও, সেটার যৌক্তিকতা হাইকোর্ট কে বা সুপ্রিমকোর্টকে বা যেকোনো স্তরের আদালতকে বিচার করার জন‍্য অনেকটা সময় লাগে। অনেক কথাই কিন্তু এই বইটা থেকে আমরা জানতে পারি। বি.জি.দেশমুখ, তিনি ক‍্যাবিনেট সেক্রেটারি ছিলেন। তিনি একটা অসাধারণ কাহিনী বলেছেন, যে আগে সিবিআই হোম মিনিস্ট্রির আন্ডারে ছিল।

ইন্দিরা গান্ধী সিবিআই কে যে শুধু প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলেন তাই নয়, ভারতের গোয়েন্দাবাহিনী যেটা এখন দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন, সবাই কে চমকে দিয়ে সেটাও নিজের হাতে নিয়ে চলে এসে ছিলেন। বি.জি.দেশমুখ, যিনি সেসময় ক‍্যাবিনেট সচিব হয়েছিলেন, তিনি বলেছেন, সেসময় তিনি দিল্লির পদ ছেড়ে দিয়ে মহারাষ্ট্রের মুখ‍্যমন্ত্রীর সচিব হতে চলেছেন। সেসময় ওয়াই.ভি.চাহ্বন কে তার প্রতি অবিশ্বাসের জন্য ইন্দিরা গান্ধী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে সরিয়ে দিচ্ছেন। তাকে অর্থমন্ত্রক দিয়ে দিচ্ছেন। এরপর ইন্দিরা গান্ধী আইবি এবং সিবিআই দুটোই নিজের হাতে নিয়ে নেন। সেই সময় নাকি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অফিসারদের মধ্যে একটা রসিকতা ছিল, যে সিবিআই বলতে বোধহয় ইন্দিরা গান্ধী মনে করছেন, ‘Central Burea Of Intelligence’. এটাও একটা গোয়েন্দা বাহিনী। সেই ভাবে তিনি সিবিআই কে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে নিজের হাতে নিয়ে এসে নিজের রাজনৈতিক স্বার্থ ব‍্যবহার করার চেষ্টা করছেন। বিজেপি ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এলো এবং যেহেতু নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা নিজেরা সিবিআই এর হাতে ভিকটিম হয়েছেন, সেই জন্য সাধারণ মানুষের অনেক আশা ছিল, হয়তো সিবিআই কে আমরা স্বাধীন, নিরপেক্ষ সংস্থা হিসেবে দেখতে পাবো। কিন্তু সেই আশায় নরেন্দ্র মোদী সরকার ছাই ঢেলে দিল।