রাজ্যে শাসকদলের ভরাডুবির জন্য বামপন্থীদের দোষ দিয়ে লাভ কি কিছু হবে?

পালা বদলের শুরু বিভাগের আজ প্রথম কিস্তি

84

সম্পাদকঃ রাজ্যের তৃণমূল দলের কাছে হারের কাটা ছেঁড়ার কাজ চলছে। কেন এই নির্বাচনী বিপর্যয় , সেই নিয়ে চলছে ময়না তদন্ত। সর্বসম্মত একটি কারণ সব নেতারাই বলছেন ,সেটা যে একটা যে দায় সারা কারণ , সেটা বুঝতে আর কারোর অসুবিধা হচ্ছে না, বলে মত রাজনৈতিক মহলের একাংশের। তৃণমূল সুপ্রিমো থেকে রাজ্যের সর্বোচ্চ স্তরের নেতারা , বিজেপির এই উত্থানের জন্য নাকি বামপন্থীরাই মূল দায়ী। তাঁরা নাকি তাদের ভোট ব্যাঙ্ক বিজেপির কাছে পয়সার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছে। বামপন্থীরা সবাই নাকি বাম থেকে রাম হয়ে গেছে। রাজ্যের শাসক দল নিজেদের দোষ খোঁজার আগেই , পরাজয়ের জন্য নতুন এই ফর্মুলা বের করে , সবার কাছে সেই ফর্মুলা ছেড়ে দিয়ে , একটা রিলিফের আবর্ত আনতে চেয়েছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। কিন্তু তিনি নিজের দলের নিচুতলার কর্মীদের জন্য বা একটু বড় নেতাদের মানসিকতার জন্য জনসংযোগ হারিয়ে ফেলেছেন , সেদিকে একবারের জন্যও নজর দেওয়া বা , সেটা কড়া ভাবে নিয়ন্ত্রণ করার দিকে না গিয়ে, নানা রকম বাহানা আনার চেষ্টা করে চলেছেন। তৃণমূল সুপ্রিমো সাধারণ মানুষের কাছে যেমন যেতেন , তাদের রান্নাঘর পর্যন্ত তার গতিবিধি ছিল। সেজন্যই তিনি প্রতি বাঙ্গালীর বামপন্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষা ও মুখ হয়ে উঠে ছিলেন। কিন্তু যখন ক্ষমতার অলিন্দে বাস করতে শুরু করলেন , তার চেলা চামুন্ডার জন্য সেই বিষয়টি হারিয়ে গেল। গিমিকের রাজনীতি গ্রাস করে ফেলল গোটা দলটাকে । এই কারণেই তৃণমূল কংগ্রেস সামান্য হলেও বেশ খানিকটা দূরে যে চলে এল সেটা বুঝতে চেষ্টা করল না কেউ। একটা দলের ভিতর, একটা মমতা ব্যানার্জির স্বচ্ছতায় গোটা দল হয়ত একটা নির্বাচনী বৈতরণী পেরোতে পারে, কিন্তু যখন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে সরকারের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিশ্রুতি ও তার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বিস্তর ফারাক চোখে আসতে শুরু করে , তখনই হারিয়ে যায় সম্পর্কের বাঁধন। তৃণমূলের মধ্যে থাকা সিংহ ভাগ ধান্দা বাজ , যারা নানা উপায়ে নিজেদের আখের গোছাতে ব্যস্ত , তাদের হাত ধরেই স্বচ্ছ ভাব মূর্তির তৃণমূল কংগ্রেস দলে ভয়ংকর ক্যানসার রোগ বাসা ফেলেছে।

এবার আসি আগের প্রসঙ্গে , তৃণমূল কংগ্রেসের দেওয়া বামপন্থীদের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দেওয়ার একটা ভুল ধারণার কথায় । বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ও তৃণমূল কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের ফারাক খুব সামান্য। তিন শতাংশের একটু বেশি। এখানে ভুলে গেলে চলবেনা , আমাদের রাজ্যে ডেডিকেটেড ভোট ব্যাঙ্ক সেই অর্থে কোন দলেরই নেই। থাকলেও খুব সামান্য। সর্বোচ্চ বারো থেকে পনেরো শতাংশের বেশি নয়। এরা সবাই সক্রিয় সমর্থক ও তার পরিবার হতে পারেন। বাকিটা সবই আসে স্যুইং বা ফ্লোটিং ভোটারদের ভোট থেকে। এই ভোটব্যঙ্ক যার দিকে ঝুঁকবে , সেই শেষ হাসি হাসবে। একটা দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, রাজ্যের শাসক দলের প্রাপ্ত মোট ভোটের সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেয়েছে , তেমনি বিজেপিরও । রাজনৈতিক মহলের একাংশ বলছেন , এই স্যুইং বা ফ্লাইংকে নিজেদের দিকে বেশি করে টানতে ব্যর্থ শাসক দল এবং বামপন্থী সমেত কংগ্রেসিরা। বামেদের সরিয়ে , বা কংগ্রেসের প্রতি অনীহা থেকে ভোট ব্যাঙ্ক মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে অনেকদিন আগেই। প্রশ্ন আসতেই পারে , কেন বিজেপির দিকে স্যুইং? একটাই কারণ, কেন্দ্রে স্থায়ী সরকার গঠন। ২৮ দলের মিলিজুলি বা এই ধরণের জোট সরকার এর আগেও দেশের জনগন দেখেছে। তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতাও আছে। সেই অর্থে মোদি সরকারকে মানে বিজেপিকে আরেকবার সুযোগ ভোটাররা দিলেন দেখার জন্য। যদি কংগ্রেস সর্ব ভারতীয় স্তরে একাই একটা স্থায়ী সরকার গঠনের ধারণা প্রকাশ করতে পারত , তাহলে হয়ত এই চিত্রটা পালটে গেলেও যেতে পারত। অন্যদিকে , কংগ্রেস জোটে আছি , আবার নাও আছি, এই মোনোভাব দেখানোর ফলে দেশের সব কেন্দ্রেই জোটের সব দলের নিজেদের মধ্যেও একটা লড়াই হয়ে ভোট ভাগাভাগি করে বিজেপিকে সুবিধা করে দিয়েছে। এই জোট বিপর্যয় একটি মাত্র কারণের জন্যই হয়েছে । সেটা আর কিছু নয় , পারস্পরিক দ্বন্দের বিষয়টা জনসাধারণের কাছে প্রকট হয়ে গেছে এই সূত্রে । এই বিষয়টাকেই ক্যাশ করেছে বিজেপি। ভুললে চলবে না , গোটা বিজেপি দলটা চলে একেবারে পেশেদারি কর্পোরেট মোনোভাবে। সেখানে আবেগ থাকে অনেক দূরে। আর বিজেপি হচ্ছে একটি ক্যাডার ভিত্তিক রাজনৈতিক দল দ্বারা চালিত। আমাদের এই পশ্চিম বঙ্গের দিকে যদি লক্ষ্য করা যায় , তাহলে দেখা যাবে , মাত্র কয়েকটি আর এস এস এর সংগঠন থেকে রাজ্যে পাঁচ হাজারের মত সংগঠনের শাখা বৃদ্ধি পাওয়ার দিকে যদি আগে রাজ্যের শাসক দল একটু নজর দিয়ে ,রাজনৈতিক বিশ্লেষণের জায়গায় যেত , তাহলে এই বিপর্যয় তাদের দেখতে হতনা। এই লেখার শেষে একটি কথা এই প্রসঙ্গে বলা ভালো, বিজেপি ধর্মের তাস খেলে এই রাজ্যে সফলতা পায়নি। তাঁরা রাজ্যের জনগনের অনেক না পাওয়ার যন্ত্রণাকে ক্যাশ করেছে । শাসকদলের দাম্ভিক সমর্থক কুলের কাছে নানা ভাবে লাঞ্ছিত ও অত্যাচারিত হয়েছে নানা জায়গার সাধারণ মানুষ । ফলে তাদের মুখ ঘুরেছে দ্রুত।সেই দুর্বল জায়গা দিয়েই মানুষের মনে ঢুকে পড়েছে বিজেপি। সেই ঘোরানো মুখ ভোট বাক্সে এসে ঢুকেছে। এমনটাই মত রাজ্যের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের। যা হবার তাই হয়েছে , বিজেপির উত্থান।