‘মহালয়া’ নিয়ে না জেনে থাকা যে সব তথ্য…

সছে শারদীয় দুর্গাপূজা- মহাশক্তির পূজা তিথি। ইতিমধ্যে উত্সবের আমেজ রয়েছে সকলের মাঝে। শারদীয় দুর্গোত্সবের প্রধান তিনটি পর্ব হলো মহালয়া, বোধন আর সন্ধিপূজা। ৮ অক্টোবর, ২০১৮ শুভ মহালয়া। মাসে দুইটি পক্ষ; সৌর আশ্বিনের কৃষ্ণপক্ষের নাম ‘মহালয়া’। মহালয়ায় পিতৃপক্ষ শেষ করে দেবীপক্ষের দিকে যাত্রা হয় শুরু। সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ সূচিত হয়। মহাভারত অনুযায়ী প্রচলিত কথায় আছে : প্রসিদ্ধ চরিত্র দাতা কর্ণের মৃত্যু হলে তাঁর আত্মা স্বর্গে গমন করে, সেখানে তাঁকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন, পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনো দিন খাদ্য প্রদান করেননি। তাই, স্বর্গে তাঁকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু তাঁর পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে পিতৃগণের জন্য কিছু পারেননি। এই কারণে কর্ণকে ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি দেয়া হয়। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।

সৌর উত্তরায়ণ দেবতাদের দিন, দক্ষিণায়ন হলো রাত। উত্তরায়ণের ৬ মাস দেবতারা জাগ্রত থাকেন, আর দক্ষিণায়নের ৬ মাস নিদ্রায় থাকেন। এদিন দক্ষিণায়নের প্রথম দিন ঘুম ভেঙে জেগে উঠেই বদ্ধ দুয়ার ঠেলে পিতৃপুরুষরা ছুটে আসবেন মর্ত্যলোকে। সনাতনধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াতগণের আত্মা মর্ত্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়, প্রয়াত আত্মার যে সমাবেশ হয় তাকে ‘মহালয়’ বলা হয়। মহালয় থেকে মহালয়া। আরও একটু পরিষ্কার করে বলতে হয়—‘মহালয়’ বলতে বোঝায় মহান+ আলয়=মহালয়। তার সঙ্গে স্ত্রীকারান্ত ‘আ’। মহালয় হচ্ছে পূজা বা উত্সবের আলয় বা আশ্রয়। কিন্তু মহালয়া (স্ত্রীলিঙ্গ) হলো কেন? পিতৃপক্ষের অবসানে, অন্ধকার অমাবস্যার সীমানা ডিঙিয়ে আমরা যখন আলোকময় দেবীপক্ষের আগমনকে প্রত্যক্ষ করি তখনই সেই মহালগ্নটি আমাদের জীবনে ‘মহালয়ার’ বার্তা বহন করে আনে। এক্ষেত্রে স্বয়ং দেবীই হচ্ছে সেই মহান আশ্রয়, তাই উত্তরায়ণের লগ্নটির নাম ‘মহালয়া’। মানে মহান আলোয় দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে আবাহন।

তর্পণ

র্ত্যে এসে প্রয়াতের আত্মা ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর থাকেন। উত্তরপুরুষদের হাতে একটু শ্রাদ্ধাহার পেলেই তারা পরম তৃপ্ত হন। জলদানের মাধ্যমে পিতৃলোকের তৃপ্তিসাধনই হলো ‘তর্পণ’। তর্পণ কেন করা হয়? ‘তর্পণ’ মানে খুশি করা। সনাতন ধর্মে কোনো শুভ কাজ করতে গেলে, বিবাহ করতে গেলে প্রয়াত পূর্বপুরুষগণের আশীর্বাদ প্রার্থনা করে, তাঁদেরকে খুশি করে শুভ কাজটি করতে ব্রতী হয়। যাদের পিতা-মাতা প্রয়াত তাদের পিতা-মাতার জন্য, সাথে সমগ্র জীব-জগতের জন্য ‘তর্পণ’/ কার্যাদি-অঞ্জলি প্রদান করতে হয়। তাঁদের সঙ্গেই পিতৃতর্পণের মাধ্যমে আমরা মানসিক ও আত্মিক সংযোগ স্থাপন করি, তাঁদেরই প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রণাম নিবেদন করি। আশ্বিন মাসের এই কৃষ্ণপক্ষের অবসান ও দেবীপক্ষের সূচনায় যে অমাবস্যাকে আমরা ‘মহালয়া’ হিসেবে চিহ্নিত করি, সেই দিনটি হচ্ছে পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার সন্ধিলগ্ন। পিতৃপূজা ও মাতৃপূজার মাধ্যমে এই দিনটিতে আমরা আমাদের এই মানব জীবনকে মহান করে তুলতে প্রয়াসী হই। শুধু তাই নয়, মহালয়ায় প্রার্থনা করি- যারা বন্ধু নন, অথবা আমার বন্ধুও, যারা জন্ম জন্মান্তরে আমার আত্মীয়-বন্ধু ছিলেন, তারা সকলেই আজ আমার অঞ্জলি গ্রহণ করুন। আজ মহালয়ায় স্মরণ করার জন্য-যাদের মাতা-পিতা-বন্ধু কেউ নেই, তাদেরকেও স্মরণ ও মঙ্গলের প্রার্থনা করতে হয়- তাদের আত্মা তৃপ্তিলাভ করুক। মার্ক্লেয় পুরাণে বলা হয়েছে, পিতৃগণ তর্পণে/ শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন।

হালয়ার দিন কৈলাশ থেকে মা দুর্গা পিতৃগৃহে আগমন করেন। দেশের বিভিন্ন মন্দিরে দেবী দুর্গার আগমনী বার্তায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঘরে ঘরে উত্সবের আনন্দ শুরু হয়। দুর্গাপূজার বাজনা বেজে উঠে সারা দেশে। দশপ্রহরণধারিণী মহাশক্তিরূপী মা দুর্গা প্রতিটি মণ্ডপে অবস্থান করবেন। সে লক্ষ্যে প্রতিটি মণ্ডপে ৮ অক্টোবর সোমবার ভোর থেকে (প্রত্যুষে) মন্দিরের চারপাশে পুরোহিতের ভক্তিকণ্ঠে শ্রীশ্রীচণ্ডীর মন্ত্র। ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা।/ নমস্তৈস্য নমস্তৈস্য নমস্তৈস্য নমো নমঃ’ কিংবা ‘চণ্ডিকে সততং যুদ্ধে জয়ন্তি পাপনাশিনী।/ রূপং দেহি জয়ং দেহি যশো দেহি দ্বিষো জহি মন্ত্র উচ্চারণের ভেতর দিয়ে দূর কৈলাশ ছেড়ে মা দুর্গা পিতৃগৃহে আসবেন। দেবী দুর্গার আগমনে বিভিন্ন মণ্ডপে ধূপের ধোঁয়ায় ঢাক-ঢোলক, কাঁসর বাজবে, মঙ্গলপ্রদীপ প্রজ্বলনে মুহুর্মুহু উলুধ্বনি হবে। মহালয়া মানে দুর্গাপূজার দিন গণনা, মহালয়া সূচনার ষষ্ঠ দিন অর্থাত্ আগামী ১৪ অক্টোবর থেকে ষষ্ঠীপূজার মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক সূচনা ঘটবে ৫ দিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোত্সবের। তবে মূলত সেইদিন থেকেই শুরু হবে দেবী দুর্গার আগমন ধ্বনি।

Posted by Independent on Friday, October 5, 2018

শুভ মহালয়া অনুষ্ঠানটি প্রতি বছর মানব জাতিকে মনে করে দেয়- দেবীর আবির্ভাব ও আগমন। সাথে এই বার্তাও নিয়ে আসে যে, যেখানেই অশুভ শক্তির বিস্তার, সেখানেই হবে শুভ শক্তির উত্থান। সকল শুভ শক্তির জয় কামনায়- শুভ মহালয়ার পুণ্যক্ষণে পিতৃমাতৃ আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে শেষ করছি- ওঁ পিতা স্বর্গঃ পিতা ধর্ম পিতাহি পরমন্তপঃ।/ পিতরি প্রীতিমাপন্নে প্রীয়ন্তে সর্বদেবতাঃ / যত্প্রসাদং জগত্দৃষ্টং পূর্ণকামো যদাশিষা/ প্রত্যক্ষ দেবতায়ৈ মে তুব্যং মাতৃ নমো নমঃ