গত ৩০০ বছর ধরে ঝড়বৃষ্টিতে নানা ভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল কলকাতা, জানুন সেই ইতিহাস

194

এখনও স্থলরেখায় পৌঁছায়নি ঘূর্ণিঝড় যশ। নিদিষ্ট গতিপথে অবতরন হতে বাকি এখনও ১০ থেকে ১২ ঘন্টা। ইতিমধ্যে আতঙ্কে প্রমাদ গুনতে শুরু করে দিয়েছেন কলকাতাবাসী। তবে ইতিহাসে কলকাতা নানাভাবে বিপর্যস্ত হয়েছিল, সেকথাই তুলে ধরেছিলেন ডঃ অতুল সুর, তার লেখা ৩০০ বছরের কলকাতার বইতে। সেই বিপর্যয়ের আংশিক কথা তুলে ধরব আজকের এই বিশেষ প্রতিবেদনে। লেখক নিখেছেন, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে জাব চার্ণক কলকাতা শহর প্রতিষ্ঠা করবার পর থেকে কলকাতার ইতিহাসে যে দুদৈর্ব ঘটনা ঘটেনি তা নয়। ঝড়, জল, ভূমিকম্প ও মহামারী দ্বারা কলকাতা বহুবারই আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু কলকাতার লোকেরা কোনদিন প্রকৃতির এ রকম মহারোষের সম্মুখীন হয়নি। বিস্মৃতির অতল গর্ভ থেকে কলকাতার দুদৈব ঘটনা সম্বন্ধে সবচেয়ে পুরানো বিবরণ যা আমার তুলে আনতে পারি, তা হচ্ছে ১৭৩৭ খ্রীষ্টাব্দের। ওই বছরে যে ঝড়-জল হয়েছিল, তাতে ধ্বসে পড়ে গিয়েছিল নব প্রতিষ্ঠিত শহরের অনেক ঘরবাড়ী।

উল্লেখ্য, ১৭৮০ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় প্রথম ইংরেজি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। ১৮১৮ খ্রীষ্টাব্দে বাংলা সংবাদপত্রেরও আবির্ভাব হয়। কিন্তু সেকালের সংবাদপত্রে আমরা বড় রকমের কোন ঝড়-বৃষ্টির সংবাদ পাইনি। বড় রকমের ঝড়-বৃষ্টির সংবাদ পাই ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দের পাঁচ অক্টোবর তারিখে। কলকাতা আক্রান্ত হয়েছিল এক অতিভীষণ ঝড় ও বর্ষণ দ্বারা।এই ঝড়ে কলকাতা বন্দরের অনেক জাহাজ বিনষ্ট হয়েছিল, শহরের বহু ঘরবাড়ী পড়ে গিয়েছিল এবং মদনমোহনতলার সামনে অবস্থিত ডাকাতে কালীর জোড়বাংলা মন্দিরটা ভূমিসাৎ হয়েছিল। ঝড়ের বেগ এত প্রবল ছিল যে শ্যামবাজারের খাল থেকে নৌকাগুলো উড়তে উড়তে উল্টাডাঙ্গায় গিয়ে পড়েছিল। এই ঝড়ে কলকাতা শহরের এরূপ ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছিল যে সেই ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ সম্বন্ধে কয়েকখানা রিপোর্ট ও বই প্রকাশিত হয়েছিল। যদিও ঝড়ের সঙ্গে অতিবর্ষণ হয়েছিল, তা সত্ত্বেও কলকাতা শহর প্লাবিত হয় নি।

পরবর্তী নৈসর্গিক দুর্ঘটনা ঘটল ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে ২৫ মে তারিখে। এক ভীষণ ঘূর্ণিবার্তার প্রভাবে ভাগীরথীতে জলোচ্ছ্বাস হল স্ট্রাণ্ড রোডের ওপর বহু ডিঙ্গি বিক্ষিপ্ত হল; ‘ইংলিশম্যান’ পত্রিকায় লিখিত হল যে আর সামান্য জল বাড়লেই হেয়ার স্ট্রীটে নৌকা চলাচল করবে। এই ঘূর্ণিবার্তার সময় ঘটেছিল এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। পুরীতে রথযাত্রা দেখবার জন্য (তখন রেলপথ হয়নি; পুরীর সঙ্গে প্রথম রেল সংযোগ হয় ১৮৯৯-তে) ‘স্যার জন লরেন্স’ নামক ম্যাকলীন কোম্পানির এক জাহাজে কলকাতা শহরের বিশিষ্ট অভিজাত পরিবারের ৮০০ মহিলা ও মধ্যবিত্ত ঘরের ২০০ মেয়ে ও পুরুষ যাত্রী বালেশ্বরে যাচ্ছিল। জাহাজখানা ডুবে যাওয়ায় সকলেরই সলিল সমাধি হয়। একজনও বাঁচেনি।

কলকাতায় সবচেয়ে বড় রকমের অভিবর্ষণ ঘটেছিল ১৯০০ খ্রীষ্টাব্দে। সাতদিন অবিশ্রান্ত ধারায় বৃষ্টিপাত হয়েছিল। বাঙলার নদীনালা সব ভেসে গিয়েছিল। কিন্তু কলকাতা শহরে বন্যার জল জমে থাকেনি। এ সময়ের এক ঘটনার কথা উল্লেখ না করে থাকতে পারছি না। বর্ষণের পর যেদিন প্রথম রেল চলাচল শুরু হল, সেদিন একটি ছোট ছেলে রেল লাইনের ধার দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ তার নজরে পড়ল যে, রেল লাইনের খানিকটা অংশ বন্যার জলে ভেসে বেরিয়ে গেছে। দূরে রেলের বাঁশী বাজছে। ছেলেটির গায়ে ছিল একখানা লাল রঙের চাদর। সে রেল লাইনের ওপর দাঁড়িয়ে লাল চাদরখানা নাড়তে লাগল। লাল চাদর দেখে ট্রেনখানা দাঁড়িয়ে গেল। সেদিন ওই ছোট ছেলেটির প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের জন্য হাজার হাজার যাত্রীর প্রাণরক্ষা হল।১৯১৮ খ্রীষ্টাব্দে কলকাতায় আবার কয়েক দিন অতিবর্ষণ হল। কিন্তু তাতে কলকাতা শহরে জল জমেনি। তবে গ্রামগঞ্জ বন্যার জলে ভেসে গিয়েছিল। সেই বন্যায় তারকেশ্বর মন্দিরের আধখানা জলের তলায় চলে গিয়েছিল।

তবে ঝড়, ঝাপট, বন্যা মহামারী ইত্যাদি ছাড়াও, কলকাতা আজও নানাভাবে বিপর্যস্ত।