কখনও কি মনে হয়েছে? মানুষের মন বড়ো অন্ধকার জায়গা

222

দূর্বা দাশগুপ্ত: মন নিয়ে কখনও মনে হয়েছে “আমি এত রাগী কেন?” বা “আমার এত সহজে চোখে জল চলে আসে কেন? “হয়ে থাকলে আপনি একা নন। এই দ্বন্দ্ব যুদ্ধে আমরা সবাই কোনো না কোনো সময়ে পড়েছি। এই প্রবৃত্তি গুলো এক একজনের এক এক রকম। হয়ত আপনি অনেক রাত করে বাড়ি ফিরেছেন একদিন। গায়ে মদের গন্ধ। মা চেচিয়ে পাড়া মাত করে ফেললেন। কিন্তু বাবা কিছুই বললেন না। শুধু বললেন “পরের বার থেকে যেন না হয়।”
তাহলে ব্যাপারটা কি হলো? দুরকম প্রতিক্রিয়ারই একটাই উদ্দীপক ছিল – আপনার দেরী করে বাড়ি ফেরা। কিন্তু প্রতিক্রিয়া দুটো পুরোপুরি আলাদা।

এ অদ্ভুত ঘটনার বিশ্লেষণ করেছেন অস্ট্রিয়ও মনস্তত্ত্ববিদ সিগমন্ড ফ্রয়েড।তিনি সারা জীবন কাজ করেছেন মানুষের মনের অন্ধকার দিক গুলো নিয়ে। যত অন্ধকার ঘেঁটেছেন, আরও অন্ধকার বেরিয়ে এসেছে। সেই অন্ধকার তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকেও গ্রাস করেছে। তাঁর থিওরিগুলোকে বলা হয়েছে অশ্লীল এবং কুরুচিপূর্ণ। ফ্রয়েড যেই সময়ে কাজ করেছেন, মধ্য আঠারোশো, তখনও যৌনতা, বিশেষ করে মেয়েদের যৌনতা কে দেখা হত নিতান্তই অপ্রয়োজনীয় হিসাবে। যৌনতার একমাত্র প্রয়োজন ছিল প্রজনন। সেই সময়ে উনি বলেন সাংঘাতিক নিন্দনীয় কথা বার্তা! যথা শিশু পুত্রের নিজের মাতার প্রতি অবচেতন যৌন অধিকার এবং শিশু কন্যার পিতার প্রতি।অতএব সমসাময়িক বৈজ্ঞানিক মহল ফ্রয়েড কে করেন ব্রাত্য। আসা যাক এবার রাগ অভিমানের কথায়।

আমাদের মন একটা সমুদ্র। তার মধ্যে হিমশৈলর মত ভেসে থাকে আমাদের চিন্তন।
এই চিন্তনেরকে ফ্রয়েড তিনটে স্তরে ভাগ করেছেন: conscious (চেতন), sub conscious (অবচেতন) ও unconscious (অচেতন)। সব থেকে ওপরের স্তর, যা সমুদ্রের জলের ওপর দিয়ে উঁকি মারছে, সেটা হলো চেতনা। চেতনা আমাদের সচেতন সিদ্ধান্ত নেওয়ায়। চেতনা আমাদের ঠিক বেঠিক, সাদা কালোর অর্থ বোঝায়। চেতনা হলো গৃহপালিত পাখি। আপনি যেই বুলি শেখাবেন, সেই বুলি বলবে।

তারপর আসে অবচেতনা। এই অবচেতনা মজার বিষয়। কখনও আধো ঘুমে চারিপাশের আওয়াজ শুনেছেন? বা ঘুম ভাঙার একটু আগে মনে হয়েছে আপনার ইন্দ্রিয় গুলো কেউ কালো পর্দা দিয়ে ঢেকে দিয়েছে? এবং সেই জন্য আপনি বাইরের কথা বার্তা শুনতে পারছেন কিন্তু বুঝতে পারছেন না? এইটা হলো আমাদের অবচেতন। আপনি চাইলেই তাকে চেতনে আনতে পারবেন। শুধু একটু চাইতে হবে। চারের নামতা আপনি জানেন। কিন্তু তাই বলে সব সময় আওড়ান না। অথচ কেই যদি জিজ্ঞেস করে চার পাঁচে কত হয়, আপনি সঙ্গে সঙ্গে কুড়ি কথাটা অবচেতন থেকে চেতনে টেনে আনবেন।

এরপর হলো অচেতন। অবচেতন সব থেকে মজাদার জায়গা। হিমশৈলের সব থেকে নিচের অংশ, যেখানে রোদ লাগেনা, যেখানে সারা বছর মৃত্যুর মত ঠান্ডা ও অন্ধকার। আমাদের অচেতনও তাই। অন্ধকার, ঠান্ডা, ক্রুর। অবচেতন খুন করে। অবচেতন ধর্ষণ করে। অবচেতন ধ্বংস করে। এই স্তরের ওপর আমাদের কোনো জোর খাটে না। অবচেতন যা করতে চায়, টাই করে। সে পোষা টিয়া না। সে বাজপাখি।

আমাদের মনের সব আঁধার, সব রাগ, বিদ্বেষ, পাপ, ঘৃণা থাকে অবচেতন নামের নরকে। এই নরককে আমরা বলি প্রবৃত্তি। Instinct।মনস্তত্ত্বে একটা টার্ম আছে, “rapist psychology”। এর অর্থ হলো, আমাদের সবার মধ্যে একজন করে potential রেপিস্ট থাকে। যারা নিজেদের ধর্ষকাম কে আগের দুই স্তর দিয়ে ঢেকে রাখতে পারে, তারা ভদ্রসমাজে ঘুরে বেড়াতে পারে। আর যারা পারেনা? জানেন তারা কি করে।শুধু ধর্ষকাম না। সব রকম অপরাধবোধই সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ ঢেকে রাখেন আগের দুই স্তর দিয়ে। যারা পারেনা তারা ক্রিমিনাল হয়। এই পারা না পারা অনেক কিছুর ওপরেই নির্ভরশীল। তার মধ্যে খুব গুরুত্বপূর্ন হলো একটা বাচ্চা কিরকম পরিবেশে বড়ো হচ্ছে। আশে পাশে কিরকম মানুষ দেখছে। সে যদি দেখে তার পারিপার্শ্বিক সবাই নিজের জান্তব প্রবৃত্তি লুকিয়ে রাখছে, তাহলে সে জানবে এটাই স্বাভাবিক। নাহলে? সমাজে আরেকজন ক্রিমিনাল বাড়বে। মন বড়ো অন্ধকার জায়গা। চির আবর্জনায় ঢাকা। এই অবর্জনা পরিষ্কার করা যায়না। যায় ঢেকে রাখা। আর একবার ঢাকনা খুলে গেলেই……..