অদৃশ্য আতঙ্কে অচেনা হয়ে উঠেছে এবারের নববর্ষ

89

সৌরভ দত্তঃ  জীবনে দেখা এই প্রথম এক নববর্ষ, যা সকলের কাছে অচেনা হয়ে উঠেছে । চিরচেনা উৎসব নেই, মানুষের মনেও নেই আনন্দ কিংবা উচ্ছ্বাস। তবে বাঙালির চিরায়ত সাংস্কৃতিক বোধ আছে, যা অনেক না থাকা নিয়েও মানুষকে শুভবোধে আর শুভপ্রত্যয়ে প্রাণিত করে। এবারে নববর্ষ ভিন্ন প্রেক্ষাপটে তবে অভিন্ন সম্মিলিত মানুষের গৃহে থাকার প্রচেষ্টার ওপর ভর করেই সব বাঁধা দূর করবে বাঙালি- সংস্কৃতি কর্মীদের এমটাই প্রত্যাশা। তবে এত সমৃদ্ধ সভ্যতা, এত পরিকল্পিত নগর কীভাবে ধ্বংস হলো? স্বাভাবিকভাবেই নানা উত্তর বিশেষজ্ঞদের মনে ধরা দিয়েছে। তৈরি হয়েছে নানা হাইপোথিসিস। বিশুদ্ধ জলের উৎস শুকিয়ে যাওয়া বা দূষিত হওয়া, খাবারের সংকট, যুদ্ধ, পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার সংকট ইত্যাদি নানা উত্তর সামনে এসেছে। কিন্তু একটি উত্তর সব উত্তরের মধ্যে অনেক সময়ই অব্যর্থ হয়ে সামনে এসেছে। মহামারী। মহামারীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যারা গিয়েছে, তারা সহজেই বিশ্বাস করে ফেলবেন, একটি সভ্যতা শুধু একটি মহামারীর কারণে খুব সহজে ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। একটি জনগোষ্ঠীর মধ্যে ছোঁয়াচে একটি ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার সংক্রমণ, তা থেকে অসংখ্য মানুষের মৃত্যু। পথে-ঘাটে-প্রান্তরে অসংখ্য মরদেহ। তা থেকে আবার নতুন সংক্রমণ। খাদ্য ও জলের সংকট। পরিণতি পুরো জনগোষ্ঠীর সার্বিক পতন। একটি সভ্যতার সমাপ্তি। তার পর ধুলোর পাহাড়ের নিচে চাপা পড়ে ধীরে ধীরে বিস্মৃতির অন্তরালে চলে যাওয়া। আমরা নিশ্চিত করে বলতে না পারলেও এ কথা বলতে পারি, অনেক সভ্যতার ভাগ্যে এমন পরিণতি আসতেই পারে।

প্রাচীন ইতিহাস থেকে লিখিত ইতিহাসের দিকে পিছিয়ে এলেও আমরা দেখব অনেক মড়ক, মারী ও মহামারীর স্মৃতি সহসা মনে পড়ছে। কোনো মড়কে লাখ লাখ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে। কোনোটায় হাজারে হাজার। মানুষ লড়েছে, প্রাণ দিয়েও প্রাণ বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম করছে। ওষুধ, চিকিৎসাসেবা দিয়ে, টিকা আবিষ্কার করে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে মহামারীতেও আত্মরক্ষা করেছে। হয়তো একটি জনপদ বা জনগোষ্ঠী সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। কিন্তু ক্ষতি হয়েছে বিস্তর। কিন্তু মড়ক, মারী, মহামারী যা-ই আসুক না কেন তা সীমিত থেকে নির্দিষ্ট অঞ্চলে। যোগাযোগের কারণে অনেকটা ছড়িয়েছে। কিন্তু তা করোনা ভাইরাসের কারণে এত দ্রুত এত দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গ্লোবাল করোনা ভাইরাসে পরিণত হয়নি।

করোনা ভাইরাস আমাদের এক নতুন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিল। আর এ বাস্তবতা আমাদের কল্পনায় অজানা ছিল না। আমরা জানতাম, আমাদের পৃথিবীটা হাজারটা সূত্রে পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত। কিন্তু কতটা সংযুক্ত, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আমাদের ছিল না। কিন্তু সংক্রামক ও ছোঁয়াচে ভাইরাস এসে আমাদের জানিয়ে গেল, আজ উহানে শুরু হলে কালই তা ভেনিসে, পরশু নিউইয়র্ক, তার পরদিন ঢাকায় আসবে। ভাইরাসটি উড়তে পারে না। পানিতে ভেসে আসে না। শুরুতে বন্যপ্রাণী থেকে ছড়ালেও এখন কোনো বন্যপ্রাণীর মাধ্যমে ছড়াচ্ছে না। মানুষে মানুষে সংযোগের মাধ্যমেই ছড়ায়। সেই মানুষ কত দ্রুত দুনিয়ার কত দিকে তা হলে চলে গিয়েছে। কতভাবে ভাইরাস ছড়িয়ে দিয়েছে সে কথা ভাবলে বিস্ময় জাগে। আজকের পৃথিবী এই বাস্তবতার সামনে আমরা দাঁড়ানো।

তারও চেয়ে বড় বিস্ময় আছে। আপাতত মানুষের চলাচল বন্ধ। বিমান বন্ধ, নৌপথ বন্ধ, সড়কপথ বন্ধ। দেশগুলোর সীমান্ত সিল করে দেওয়া। শহরগুলোর সীমান্ত বন্ধ। তবু পৃথিবীটা অদ্ভুতভাবে সংযুক্ত এখনো। এখনো সবাই সবার খবর পাচ্ছে। কোথায় কী হচ্ছে মুহূর্তে জানতে পারছে। পৃথিবীর কোনায় কোনায় কোথায় কে আক্রান্ত হলো, সে খবর অজানা থাকছে না অপর প্রান্তের একজনের। প্রত্যক্ষভাবে শারীরিক উপস্থিতির যে যোগাযোগ পৃথিবীকে ব্যস্ত, পৃথিবীতে পরিণত করেছে তারই সমান্তরালে আরেক পৃথিবী তৈরি হয়েছে, যা শারীরিক সব যোগাযোগ প্রায় বন্ধ হয়ে গেলেও পৃথিবীকে সংযুক্ত রাখতে সক্ষম।

করোনা ভাইরাসের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটাল যোগাযোগ ব্যবস্থা নতুন করে তার সক্ষমতা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির হলো। শুধু সক্ষমতা নয়, একটা বাস্তবতা হিসেবেও হাজির হলো। করোনা ভাইরাস নিয়ে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটা চারদিকে ঘুরছে তা হলো, এ ভাইরাস যাবে কবে? কারও কাছে এ প্রশ্নের সদুত্তর নেই, কিছু অনুমান ছাড়া। চীন তিন মাসের দুঃস্বপ্ন পার করে স্বাভাবিক অবস্থার দিকে ফিরছে। কিন্তু এই স্বাভাবিক নতুন আরেক স্বাভাবিক। মানুষের স্পর্শ আর প্রত্যক্ষ যোগাযোগের ক্ষেত্রে প্রতিটি পদক্ষেপ হিসাব করে ফেলতে হবে। নইলে আবার সংক্রমণের মহামারীর মধ্যে পড়তে হবে। যে সমাজ এই নতুন স্বাভাবিকে প্রত্যাবর্তন করবে, তাকে এই নতুন নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হবে। একে বলা যায়, করোনা ভাইরাসের শিষ্টাচার। আর এ অবস্থা হয়তো এক বছর এমনকি দুই বছর পর্যন্ত চলবে। লকডাউন বা জরুরি পরিস্থিতি চলবে তিন থেকে ছয় মাস। ছোঁয়াছুঁয়ি বাঁচিয়ে চলতে হবে আরও এক থেকে দুবছর। আর করোনার অর্থনৈতিক ও সামাজিক অভিঘাত হয়তো বহু বছর বয়ে যেতে হবে। অর্থনৈতিক অভিঘাতের খবর আমরা সবাই জানি। কিন্তু সামাজিক বা সাংস্কৃতিক অভিঘাতের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কেমন হবে?

করোনা-পরবর্তী সময়ে স্পর্শ বা সংযোগ বাঁচিয়ে চলা সচেতন সাধারণের জীবনে সবচেয়ে বড় বিবেচনার বিষয় হবে। যে সংযোগ বা স্পর্শ বিশ্বস্ত নয় তা লোকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় না হলে এড়িয়ে চলতেই চাইবে। লোকে হয়তো টাকার বদলে ডিজিটাল বা কার্ডের লেনদেনে বেশি আগ্রহী হবে। কাগজের বইয়ের চেয়ে ই-বুকের দিকে বেশি আগ্রহ তৈরি হবে। প্রত্যক্ষ সংযোগ বাঁচিয়ে যা করা সম্ভব, তাই করতে চাইবে। প্রথমে সচেতন মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্তের মানুষরা এই চর্চা আয়ত্ত করবে। পরে অন্যরাও এই আচরণের দিকে আকর্ষিত হবে। বাজারে যেতে হবে, সবজি, মাছ, মাংস, চাল, ডাল, ডিম, দুধ কিনতেই হবে। কিন্তু সাবধানতার মাত্রাটা অন্যরকম থাকবে। গণপরিবহনে চলতে গিয়ে তৈরি হওয়া তীব্র সংশয় ও সন্দেহ তাকে হয়তো বিকল্প উপায়ের সন্ধানের দিকে আগ্রহী করে তুলবে। আমরা হয়তো দেখব, শহরে চলাচলের জন্য লোকজন আগের থেকে অনেক বেশি বাইসাইকেলের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠছে। আর লোকের এই আগ্রহের প্রতি সাড়া দিতে হবে সরকারগুলোকে। মানুষের আচরণের এই পরিবর্তন আরও বহু অনুষঙ্গকে প্রভাবিত করবে।

সেসব হয়তো এখন অতিচিন্তা মনে হতে পারে, কিন্তু একটা বিষয় অতিচিন্তা নয় । তা হল লোকে আগের থেকে অনেক বেশি ডিজিটাল মাধ্যমের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। এরই মধ্যে অপশনাল মাধ্যমগুলো অনিবার্য হয়ে উঠেছে। অনলাইন সংবাদপত্রের জনপ্রিয়তা বাড়ছে, ফেসবুক, ইউটিউব, নেটফ্লিক্সের মতো মাধ্যমগুলোর ওপর মানুষের নির্ভরতা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে বেশি। সুযোগ বাড়লে অনলাইন ব্যাকিং বা টাকাবিহীন কেনাকাটার প্রবণতা অনেক বেশি বাড়ত এই সময়ে। আর ডিজিটাল নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ একেবারে চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গেছে দেশে দেশে। লকডাউন উঠলেও এ নজরদারি উঠবে এমন নিশ্চয়তা কেউ দিচ্ছে না।

পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, গ্লোবাল করোনা পরিস্থিতি আমাদের কোথাও কোথাও ১২ বছর পিছিয়ে দিলেও, ডিজিটাল সংযোগের অনিবার্যতার ক্ষেত্রে ১২ বছর পরের বাস্তবতায় পৌঁছে দিল। হিন্দুরা প্রার্থনা হচ্ছে ঘরে ঘরে ।কারন দক্ষিণেশ্বর, তারাপীঠ, কামাখ্যা, অমরনাথ থেকে কালীঘাট সব জায়গাতেই জনমানবহীন। সাথেই আল্লাহ কেও ডাকছেন ঘরে বসে অনেকেই। আজও তার অন্যথা হবে না । এদিকে ইস্টার ও গুড ফ্রাইডের প্রার্থনা ফাঁকা চার্চ থেকে অনলাইনে সম্প্রচারিত হচ্ছে। বহু মানুষ অনলাইনে অফিস করছেন। স্কুল-কলেজের ক্লাস হচ্ছে অনলাইনে। বড় বড় জমায়েত বন্ধ। এমন পরিস্থিতিতে নববর্ষ পালিত হচ্ছে অনলাইনে শুভেচ্ছার আদান প্রদানের মাধ্যমে । মনে পড়ছে চাইনিজ নতুন বছরের কথা। নতুন বছর স্বাগত জানানোর প্রাক্কালে চীনারা করোনা ভাইরাসের কবলে পড়ে। লোকজন ছুটিতে বাড়ি গিয়ে আটকা পড়ে। তার পরের সংবাদ তো সবার জানা। বাংলা নববর্ষেও একই পরিস্থিতি। সংক্রমণ বাড়ছে। লোকে ছুটিতে নানা জায়গায় আটকা পড়ে আছে। লকডাউন। বাড়ছে সংক্রমণের সংখ্যা। বাড়ছে মৃত্যুও। নতুন বাস্তবতা মেনে বাংলা নতুন বছরে লোকে কতটা সৃষ্টিশীলতার সঙ্গে ডিজিটাল নববর্ষ পালন করে, সেটাই এবার দেখার বিষয়। কেননা সামনের দিনে হয়তো ডিজিটাল নববর্ষই আমাদের প্রধান উৎসব হবে। অনাগত সে দিনের একটা ট্রায়াল হয়ে যাবে এবার। আর যদি করোনা ভাইরাস পৃথিবীতে বেশ কিছুদিন থেকে যায়, তবে জীবিতরা নতুন যে পৃথিবী দেখবে, সেখানে শুধু নববর্ষ নয়, আরও বহু কিছুই দ্রুত ডিজিটালাইজড হয়ে যাবে।