‘লড়াই হোক আজকের হিটলারের সঙ্গে’ – সাংবাদিক অশোক মজুমদারের কলম

75

 

        অশোক মজুমদার

শুভ বিজয়া, পাড়ার ফাঁকা প্যান্ডেলটার পাশ দিয়ে আসছিলাম। ফাঁকা প্যান্ডেল দেখলেই আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে যায়, এখনও। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এই মন খারাপটাও যেন পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। জনমানবহীন পরিত্যক্ত কাঠামোটা যেন আমাদের দেশের কমিউনিস্ট পার্টিগুলির মত। কাঠামো আছে, তত্ত্বও আছে শুধু মানুষ নেই। বিশেষ করে সিপিএমকে দেখলে আমার একথাটাই মনে পড়ে। মানুষের সঙ্গে দলটির সংযোগ যে কোন তলানিতে এসে পৌঁছেছে তার একটা সাম্প্রতিক নমুনা হল রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের লেখা নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু বইটি। প্রকাশের আগে বিভিন্ন সূত্রে শুনছিলাম, বুদ্ধদেববাবু বহুদিন ধরে দীর্ঘ গবেষণার পর বইটি লিখছেন। সত্যিই তিনি এখন অসুস্থ, সাদা দাড়ি ঢাকা মুখে তাকে এখন অনেকটা সন্তের মত লাগে। তার সৃষ্টিকর্ম নিয়ে আলোচনার সাহস আমার মত সামান্য মানুষের নেই। আমার শুধু একটাই প্রশ্ন আজকের দিনে এই বইটির প্রাসঙ্গিকতা ঠিক কোথায়?

আমি জানি এই প্রশ্নটা শুনেই কমরেডরা আমাকে তেড়ে মারতে আসবেন। বলবেন, বিজেপির মত ফ্যাসিস্ট শক্তির উত্থানের সময় এই গ্রন্থের প্রাসঙ্গিকতা আছে। তাদের বলি, সোজা কথা সোজা ভাবে বলার সৎ সাহস তারা আর কবে অর্জন করবেন? যখন বিজেপির স্বৈরাচারী কার্যকলাপ একটা রক্তমাংসের চেহারা নিচ্ছে তখন আমরা কেন ফ্যাসিজমকে বোঝার জন্য সেই হিটলারের আমলে ফেরৎ যাবো? বিশেষ করে কোন আইনকানুন ও সংবিধানের তোয়াক্কা না করা এই দলটির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে লড়াই করাটাই যখন একান্ত জরুরি হয়ে পড়েছে? এই হল বুদ্ধবাবুদের সমস্যা, সিপিএমের সমস্যা। বাস্তবে বিজেপি বিরোধী জোট গড়ার কাজকে তারা নানারকম টালবাহানা করে পিছিয়ে দিচ্ছেন। আবার ফ্যাসিজমের বীভৎসতা বোঝানোর জন্য লিখছেন একটা গম্ভীর কেতাব। ভুলেই যাচ্ছেন, বইপত্তর ফ্যাসিস্টদের ঘোরতর অপছন্দের জিনিস হলেও কোন দেশে কোন কালে ফ্যাসিজমকে বই লিখে রোখা যায় নি।

সিপিএমের এই কাজকারবার দেখে আমার বিশিষ্ট নাট্য সমালোচক দেবাশিস দাশগুপ্তের একটা লেখার হেডিং মনে পড়ে গেল টিকিট কেটে বিপ্লব। লেখাটার মূল প্রতিপাদ্য ছিল বাস্তবের থেকে পালিয়ে গিয়েই বিপ্লবী বামপন্থী নাট্যপরিচালকরা মঞ্চে বিপ্লব দেখাচ্ছেন, সেই বিপ্লব আটকে আছে একাডেমির মত কিছু নাট্যমঞ্চেই। এ যেন দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। সত্যি বলতে কী জরুরি অবস্থার সময়ে তথাকথিত দক্ষিণপন্থী দলগুলি ইন্দিরার বিরুদ্ধে যতটা সরব ছিলেন সরকারি বামপন্থীরা ততটা নয়। তাদের বিপ্লব আটকে ছিল কিছু গ্রন্থ প্রকাশ, ছোট পত্রিকায় চিন, ভিয়েতনাম, কাম্বোডিয়া, লাওসের মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে প্রবন্ধ রচনায়। এটা যে খারাপ তা আমি বলছি না, এটা যে ভুল তাও নয়। কিন্তু তার থেকেও আরও জরুরি ছিল পথে নেমে সেই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা। যেটা করেছিলেন সি আই এর দালাল বলে বিজ্ঞাপিত গৌরকিশোর ঘোষ, জ্যোতির্ময় দত্তরা। সেই ট্র্যাডিশন সিপিএম এখনও ধরে রেখেছে। বুদ্ধবাবুর দু খন্ডে প্রকাশিত ফিরে দেখা নামে বইটির প্রথম খন্ডেও বিজেপির বিপদ সম্পর্কে তেমন কোন আলোচনা চোখে পড়ল না।

সামান্য জ্ঞানবুদ্ধিতে আমার যা মনে হয় বাস্তব পরিস্থিতি ও প্রান্তবাসী মানুষদের রোজকার লড়াই, তাদের রুটিরুজির সমস্যা সমাধানকে এড়িয়ে বিদেশী সাফল্যের উদাহরণ এবং তাদের নেতাদের কৃতিত্বকে তুলে ধরতেই আমাদের দেশের সব ধরণের কমিউনিস্ট দলগুলি বেশি আগ্রহী। আমি নিজে খুব অল্প বয়সেই অতিবাম রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েছিলাম, সেই অভিজ্ঞতা থেকেই একথা বলছি। সে অবস্থা এখনও খুব একটা বদলায়নি। আবার যারা নিজেদের চিন্তাভাবনা বদলেছেন তারা মূল ধারার রাজনীতিতে তেমন কোন জায়গা করে নিতে পারেন নি। এদের কাছে বড় নেতা মানেই লেনিন, স্তালিন, মাও সে তুং, ট্রটস্কি, লুলা, স্যাভেজ এসব নাম। এখানে দেশের কোন বড় জাতীয় নেতার নাম এদের মুখে আপনি শুনবেন না। কোন দেশের কমিউনিস্ট পার্টির কে সমর্থক তা নিয়েই দলাদলি করে এদের পার্টি ভাগ হয়েছে। বিপ্লব তাতে মোটেই তরান্বিত হয়েছে এমন নয়। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি!

দলে কমরেড দাদাদের কাছ থেকে এ নিয়ে জানতে চাইলে শুনেছি এসব এখন বুঝবি না, বড় হলে বুঝবি। তোর যা কাজ তাই কর। কাজ বলতে ছিল রেড বুক পড়া, মাওয়ের উদ্ধৃতিতে ভরা সেই বইয়ে শুধু তাঁর চিনের বিপ্লবের নানা অভিজ্ঞতার কথা রয়েছে। ভাবতাম, আমাদের দেশে এসব কী কাজে আসবে? তা না বুঝেই দেওয়ালে লিখতাম, চেয়ারম্যানের চিন আক্রান্ত হতে পারে, বিপ্লবের কাজ দ্রুততর করুন। আর কাজ বলতে ছিল পাথরের খাদান থেকে গান পাউডার জঙ্গলের ভিতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে দাদাদের হাতে পৌঁছে দেওয়া। ভাবতাম, এসব বারুদ থেকেই হয়তো দেশের বিপ্লব ঘটানোর মত কোন বড় বিস্ফোরণ হবে।

যেখানে থাকতাম তার চারপাশে হত দরিদ্র মানুষের বাস, আমি নিজেও এসেছি একটি অত্যন্ত গরিব পরিবার থেকে কিন্তু কমরেডদের মুখে দেশের মানুষের সমস্যা সমাধান নিয়ে তেমন কোন আলোচনা শুনতাম না। শুধু চারু মজুমদারের বক্তব্য, শশাঙ্ক বা সরোজ দত্তের লেখা আর দেশ বিদেশের বিপ্লবের উদাহরণ এই ছিল আমার রাজনীতির সহজ পাঠ। অথচ দেখেছি আমার রাজনৈতিক দাদারা কী সাহসী, সৎ ও নিষ্ঠাবান। আমরা সবাই দলটা করতাম ভালোবেসে। সি এম এবং সরোজ দত্তর রাজনৈতিক সততা নিয়েও কোন প্রশ্নই উঠবে না। কিন্তু মানুষের দাবি ও চাহিদাগুলিকে না বুঝতে পারা আমাদের বিপ্লব করার চেষ্টাকে ব্যর্থ করে দিল। সৎ, বুদ্ধিমান এবং ত্যাগী কর্মীদের সংখ্যা এখনও দেশের তৃতীয় ধারার রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে অনেক বেশি। দেশের কিছু কিছু অংশে তাদের প্রভাবও রয়েছে। কিন্তু সময়ের দাবি বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণের ব্যর্থতা তাদের সাফল্যের অন্তরায়।

এ রোগ আর গেল না। আমরা নিজেদের কোন ভুল বুঝতাম না, সমালোচক মাত্রই ছিল সংশোধনবাদী। পরবর্তীকালে যখন আমি সিপিআইএমএল ( পি সি সি) সঙ্গে যুক্ত তখনও বোলপুরে ছাত্রদের একটা মিটিং-এ বক্তব্য রাখার সময় দেখেছি সময় বদলালেও অসহিষ্ণুতা একই আছে। এই গোষ্ঠীটার সঙ্গে বর্তমানে টিএমসির ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টের নেতা প্রদীপ ব্যানার্জিও যুক্ত ছিলেন। কলেজের প্রতিনিধি হয়ে সেই বৈঠকে আমি বলেছিলাম, নিজেদের মধ্যে এত দলাদলির জন্য আমরা মানুষের মূল সমস্যায় ঢুকতে পারছি না। শুধু চিন, কাম্পুচিয়া, আলবেনিয়া, ভিয়েতনামের কথা বলে আমাদের দেশের বিপ্লব হবে না। বক্তব্য শেষ করার পর দেখলাম অনেকে বেশ গম্ভীর। আমার সঙ্গে যাওয়া কমরেড বললো, অশোক তুই যা বললি সেটা আমারও মনের কথা। কিন্তু এরা কথাগুলো পছন্দ করেনি, তুই ফিরে যা নইলে বিপদ হতে পারে।

দেশের বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে মানুষের যে এক দূরত্ব তৈরি হয়েছে তা বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বুঝতে পেরেছিলেন। এই দুর্বলতা ও দ্বিচারিতার জায়গায় আঘাত করেছিলেন তিনি। সিপিএমের ৩৪বছরের সাজানো সংসার ভেঙে তছনছ হয়ে গেল। কিন্তু সিপিএম এই ঘটনা থেকে কোন শিক্ষাই নেয়নি। তাই তারা বিজেপির বিরুদ্ধে সক্রিয়ভাবে জোট বাধার ব্যাপারে কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না। বুঝতেই পারছে না একটা সাম্প্রদায়িক দল দেশকে টুকরো টুকরো ভাগে ভাগ করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চাইছে। এখন হিটলারের উদাহরণ নয় মোদীর মত একজন জীবন্ত হিটলারের সঙ্গে লড়াইটা এখন অনেক জরুরি।

কোন সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনীতি নয়, দেশজোড়া এই লড়াইয়ের জন্য প্রয়োজন সমস্ত বিরোধী দলগুলির একটা বৃহত্তর যুক্তফ্রন্ট। কোন বংশ পরিচয় কিংবা দলের প্রাচীনত্ব নয় বরং লড়াইয়ের অভিজ্ঞতা, ত্যাগ, গ্রহণযোগ্যতা এবং জন সমর্থনের ভিত্তিতে ঠিক হোক এই ফ্রন্টের নেতৃত্ব। সিপিএমের মুশকিল হল, তারা এই সত্যটা মানতে চাইছেন না। কোন পদ বা ক্ষমতার আশায় নয়, দেশের বাস্তব পরিস্থিতি বুঝেই মোদীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সবাইকে নিয়ে জোট বাধতে হবে। কারণ, এই মুহূর্তে এটা না করা গেলে দেশে রাজনীতি করার কোন জায়গাই থাকবে না। বুদ্ধবাবুর বইয়ের পাতায় নয়, দেশের বিভিন্ন কোণে মোদীর কার্যকলাপে আমরা হিটলারের পদধ্বনি শুনছি। লড়াই হোক আজকের হিটলারের সঙ্গে। বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলির বৃহত্তর যুক্তফ্রন্ট আজ সময়ের দাবি। আজকের রাজনীতিকে দেশের মানুষের এই মনের কথাটা পড়তে শিখতে হবে।

আর কতবার আমরা অস্তে এসে উদয়ের উপমায় কবিতা সাজাবো।