শতাব্দী প্রাচীন কলকাতার প্রথম পারিবারিক পুজো সম্পর্কে জেনে নিন অজানা কিছু তথ্য

218

সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের দুর্গাপুজো কলকাতার সবথেকে পুরোনো পারিবারিক পুজো। জমিদার লক্ষ্মীকান্ত মজুমদার প্রথম আটচালার দুর্গা প্রতিমার পুজো শুরু করেন স্ত্রী ভগবতী দেবীর ইচ্ছেয় ১৬১০ সালে। এই পরিবার মোট ৮ টি আলাদা আলাদা প্রতিমার পুজো করে থাকেন।এই প্রতিমা কিছুটা লাল রঙের বা হালকা সোনালী রঙের হয়ে থাকে। দশমহাবিদ্যা দ্বারা প্রভাবিত মা দুর্গার বিভিন্ন রূপের পূজা করা হয়। অসুরের রং সবুজ রঙের হয়। সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের দুর্গা পূজা বিদ্যাপতি রচিত দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী তে উক্ত নিয়ম বা রীতি মেনে সম্পন্ন হয়। প্রথমে এই পুজোটি বড়িশার জমিদার বাড়িতে চণ্ডীমণ্ডপ এ হতো। পরবর্তী কালে সকলেই যাতে এই পুজোর অংশ হয়ে উঠতে পারে সেই কারণে মোট আটটি পুজো শুরু করা হয়।

এর মধ্যে শুধু বরিশাতেই ৬ টি পুজো হয়। সেগুলি যথাক্রমে আটচালা বাড়ি পুজো ,বড় বাড়ি পুজো ,বেনাকি বাড়ি পুজো ,মেজো বাড়ি পুজো ,কালীকিঙ্কর ভবন পুজো এবং মাঝের বাড়ি পুজো। বড়িশাতেই মোট এই আটটি পুজো সম্পন্ন হয়। সপ্তম পুজো টি হয় বিরাটি তে বিরতি বাড়ি পুজো এবং অষ্টম পুজোটি নিমতা তে নিমতা পাঠানপুর বাড়ি পুজো নামে প্রসিদ্ধ। এই পরিবারের দূর্গা পুজো যেরকম রীতি মেনে সম্পন্ন হয় তাতে যোগিনী এবং উপদেবতারাও মহাসপ্তমী ও মহাষ্টমী তে পূজিত হন। শাক্ত -শৈব -এবং বৈষ্ণব এই তিন ধারার ই প্রভাব এই পুজোয় দেখা যায় সেই জন্য এই পুজোর মহিমা বাকি সব পুজোর থেকে আলাদা। প্রতি বছরই সমস্ত রকম নিয়মানুবর্তিতা মেনে এই পুজোটি সম্পন্ন হয়।

প্রসঙ্গত, সাবর্ণ কূলের পারিবারিক পরিচয় ব্রহ্মা থেকে উদ্ভূত এক উল্লেখ্য স্মৃতি।সমকূল বিশিষ্ট নবম আব্দে ঋষি সাবর্ণির নামানুসারে সাবর্ণ গোত্র বা গোষ্ঠী পরিচয় লাভ করে সেই সময়ে। এই গোষ্ঠীর আদি বাসস্থান ছিল তৎকালীন কাণ্যকুব্জ, যা এখন উত্তরপ্রদেশের কনৌজ নামে খ্যাত।

রাজা আদিশূর যে ব্রাহ্মণ পঞ্চককে কাণ্যকুব্জ থেকে এনেছিলেন তাঁরা রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ নামে পরিচিত। সেই ব্রাহ্মণ পঞ্চক হলেন- ১) শ্রী বেদগর্ভ, ২) শ্রী দক্ষ, ৩) শ্রী ভট্টনারায়ণ, ৪) শ্রী হর্ষ এবং ৫) শ্রী ছন্দ (ছান্দড়)। তখন বঙ্গদেশে সপ্তশতী ব্রাহ্মণগণের মধ্যে যজ্ঞকার্যে পারদর্শী কেউ না থাকায় রাজা আদিশূর বিশেষ যজ্ঞকার্য সম্পাদনের নিমিত্ত উক্ত ব্রাহ্মণ পঞ্চককে সাদরে নিজ রাজ্যে এনেছিলেন। তারমধ্যে ঋষি সাবর্ণির পুত্র ঋষি সৌভরি ছিলেন একজন বাকসিদ্ধ বেদজ্ঞ সাগ্নিক ব্রাহ্মণ। মহারাজা আদিশূরের প্রার্থনা শুনে মহারাজ চন্দ্রকেতু গৌরবঙ্গে পাঁচজন বেদজ্ঞ সাগ্নিক ব্রাহ্মণ প্রেরণ করেছিলেন।

পঞ্চক ঋষিপুত্রগণের মধ্যে সাবর্ণ গোত্রীয় সৌভরি পুত্র বেদগর্ভ পেয়েছিলেন গৌরমণ্ডলের বটগ্রাম নামক একটি বর্ধিষ্ণু গ্রাম।(বর্তমানে মালদহ জেলায় গঙ্গাতীরে বটরি বা বটোরিয়া গ্রাম)। তখন পণ্ডিত বেদগর্ভের বয়স ছিল ৪০বছর। তাঁর স্ত্রীর নাম অম্বালিকা দেবী। পণ্ডিত বেদগর্ভের ভৃত্য ছিলেন বিশ্বামিত্র গোত্রীয় শ্রী কালিদাশ মিত্র। তিনিও পণ্ডিতের সাথে কাণ্যকুব্জ হতে বঙ্গে আসেন এবং সপরিবারে বসবাস করেন।

সৌরাষ্ট্রের(গুজরাটের) প্রভাসে ভদ্রকালী মন্দিরে সংরক্ষিত ভাবা বৃহস্পতির ভেরাবল প্রশস্তিতে উল্লিখিত আছে যে বঙ্গদেশে আগমনের আগে তৎকালীন সুবিখ্যাত শৈব পণ্ডিত বেদগর্ভকে “উপাধ্যায়” উপাধি প্রদান করেন এবং সৌরাষ্ট্রের প্রখ্যাত সোমনাথ মন্দিরের (দ্বাদশ জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম) প্রধান পুরোহিত রূপে বরণ করেন। পরবর্তীকালে পিতার আজ্ঞা পালনের জন্য পণ্ডিত বেদগর্ভ গৌরবঙ্গে স্বপরিবারে আগমন করেন। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে পণ্ডিত বেদগর্ভ বঙ্গদেশে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সম্ভবত পুনরায় সোমনাথ মন্দিরে ফিরে যান এবং যবন আক্রমণে শহিদ হন।খ্রিষ্টীয় ১৬০৮ সালে সাবর্ণ গোত্রীয় শ্রী লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় জাহাঙ্গীরের থেকে লাভ করেছিলেন ৮টি পরগণার (উত্তরে হালিশহর থেকে দক্ষিণে ডায়মন্ড হারবার পর্যন্ত) নিষ্কর জমিদারি এবং রায় ও চৌধুরী উপাধি, গুরুদক্ষিণা হিসাবে মানসিংহের দ্বারা। কারণ? মানসিংহ ছিলেন জীয়া গঙ্গোপাধ্যায় ওরফে কামদেব ব্রক্ষ্মচারীর (লক্ষ্মীকান্তের পিতা) শিষ্য। ১৬১০ সালে শ্রী লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় এবং তাঁর স্ত্রী ভগবতীদেবী শুরু করেছিলেন কলকাতার প্রথম দুর্গাপূজা, বড়িশার আটচালায় কারণ বড়িশা তখন উন্নত জনপদ।

বড়িশা আটচালা বাড়ীতে লক্ষ্মীকান্ত ১৬১০ সালে মেড় সহ সপরিবার অর্থাৎ লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গনেশ, কলা বউ সহ মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গার পুজো শুরু করেন। এরপূর্বে বঙ্গদেশে দুর্গার পুজো শুরু হলেও তা সপরিবার দুর্গা ছিল না। দুর্গাপূজা হয় মধ্যযুগের হাতের লেখা কবি বিদ্যাপতি রচিত পুঁথি “দুর্গাভক্তিতরঙ্গিনী” মতে। বলির জন্য কামার আসতেন রামচন্দ্রপুর থেকে। বর্তমানে পশুবলি প্রথা বন্ধ হয়েছে। বড়িশার অদূরেই ছিল প্রতাপাদিত্যের কাকা বসন্ত রায়ের রাজধানী সরশুনা। সরশুনাতে আছে একটি বৃহৎ দিঘি। বসন্ত রায়ের নামানুসারে এই দিঘির নাম হল “রায় দিঘি”। এই রায় দিঘির পাশের গ্রামে লক্ষ্মীকান্তের দুর্গাপুজোয় ঢাকে কাঠি পড়ত। সাবর্ণ রায় চৌধুরী পাড়া দুর্গাপুজোর শুরু থেকেই সাবর্ণপাড়া নামে পরিচিত ছিল। সাবর্ণ রায় চৌধুরীগণ বড়িশা এলাকাতে তাঁদের কুলীন জামাতাদেরও বাসস্থান দিয়েছিলেন। কুলীনপাড়া নামে সেই পাড়া বর্তমানে পরিচিত। চিকিৎসক হিসাবে বৈদ্যদের বসতি দান করায় বৈদ্যপাড়া সৃষ্টি হয়েছে