আজ থেকে ৪৪ বছর আগে ভারতে কেন জারি হয়েছিল জরুরি অবস্থা?

187

ঠিক আজকের দিনে ৪৪ বছর আগে, ১৯৭৫ সালে ২৫ জুন ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং ভারতের জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ।আর এই জরুরি অবস্থা জারি ছিল ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত । কিন্তু কেন জারি হয়েছিল ভারতে জরুরি অবস্থা? সে ব্যাপারে তথ্য ঘেঁটে জানা গিয়েছে , এই জরুরি অবস্থার সূচনা হয়েছিলো ১৯৭৫ সালের ২৬-এ জুন সকালবেলায়। তবে এর প্রস্তুতি চলেছিল অনেক আগে থেকেই। দেখা গিয়েছিল যে, দেশের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতিতে ১৯৭৫-এর ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরিয়েছিল। মুলত এই রায়ে রাজনারায়ণের আনা মামলায় ইন্দিরা গান্ধি নির্বাচনে দুর্নীতির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন এবং ৬ বৎসর পার্লামেন্টারি রাজনীতি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারপতি জগমোহনলাল সিংহ রায়বেরিলি লোকসভা কেন্দ্রে প্রার্থী হিসাবে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধির নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতার অধিকার তিনি খারিজ করে দিয়েছিলেন। যাইহোক, এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরোনোর দিনই গুজরাট বিধানসভার নির্বাচনের ফলাফল বেরিয়েছিল এবং তাতে কংগ্রেস পরাজিত হয়েছিল।

এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরোনোর ১৩ দিন পর অর্থাৎ ২৫-শে জুন বিরোধী দলগুলি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে, তাঁরা এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে সারা দেশে এক সপ্তাহব্যাপী শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ দেখাবে এবং ঐ দাবি জানাতে তাঁরা একদিন প্রধানমন্ত্রীর বাড়িতেও যাবে। কিন্তু বিরোধী দলগুলি এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধি বেছে নিয়েছিলেন মানুষের অধিকার হরণের রাস্তাটিকে, এমনটাই অভিযোগ উঠে এসেছে বারবার । শুধু তাই নয় আসলে নেতৃত্ব ও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তিনি এতটাই আতঙ্ক হয়ে পড়েছিলেন যে তাঁর প্রতিটি কাজের মধ্যে ভীত ও সন্ত্রস্ত মনোভাবের পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল। আর সেই কারণে দলের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই তিনি যে স্বৈরতান্ত্রিক আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা করে আসছিলেন, সেটা আরও প্রবল হয়ে উঠেছিল। এমন অবস্থায় ক্ষমতাই থাকার ভবিষ্যৎ তাঁর যতই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছিল ততই তিনি ক্ষমতাই থাকতে চাইছিলেন। অর্থাৎ, সমস্যা সমাধানের কোনো কল্যাণকামী নীতি গ্রহণ তাঁর পক্ষে নেওয়া সম্ভব ছিল না, তাঁর বা তাঁর দলের শ্রেণিস্বার্থেই। তাই তিনি বেছে নিয়েছিলেন এই রাস্তাটিকে। ইতিমধ্যে ২৫-এ জুন জয়প্রকাশ নারায়ণ দিল্লিতে ঘোষণা করেছিলেন যে, ইন্দিরা গান্ধি ভারতে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চলেছেন এবং জনসাধারণকে এজন্য সতর্ক হতে বলেন (‘দি টাইমস-লন্ডন, ২৭ জুন, ১৯৭৫)। সেই ২৫ জুন রাত্রেই শুরু হয়েছিল ভারতের বিভিন্ন স্থানে সি. পি. আই বাদে অন্য বিরোধী দলগুলির নেতা ও কর্মীদের গ্রেপ্তার। ২৬ জুন রাষ্ট্রপতি ফকিরুদ্দিন আলি আহমেদ সংবিধানের ৩৫২ নং ধারার, ১ উপধারা অনুসারে দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন এবং বলেছিলেন- ‘a grave emergency exists whereby the security of India is threatend by internal disturbances.’। এর ফলে ভারতের রাজনীতিতে স্বৈরতন্ত্র একটা পাকাপাকি ভিত্তি পেয়ে গিয়েছিল।

১৯৭৫ সালের ২৬ জুন জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপর অভাবনীয় আক্রমণ নেমে এসেছিল। তাই দেখা গিয়েছিল যে, ২৬ জুন সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার সঙ্গে সরকারি আদেশগুলিকে বিচারবিভাগের আওতার বাইরে রেখে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে সেভাবে ঘোষণা করেই ক্ষান্ত হননি, বিনা বিচারে যেকোনো ব্যক্তিকে জেলে পুরে রাখার জন্য নতুন করে মিসা অর্ডিন্যান্স হিসাবে চালু হয়েছিল যা তিন সপ্তাহের মধ্যে তিনবার সংশোধিত হয়েছিল। এমনকি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, বক্তৃতার স্বাধীনতা, সংগঠন ও জমায়েতের অধিকার, ধর্মঘটের অধিকার, বিক্ষোভ-প্রতিবাদের অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। অনেক রাজ্যে ছাত্র ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। শ্রমিক, কর্মচারী, খেতমজুর, কৃষক, সাধারণ মানুষকে বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই থেকে দূরে রাখা হয়েছিল মিশা, ডি. আই. আর ইত্যাদি আইনে গ্রেপ্তার ও জেলে পুলিশি অত্যাচারের ভয় দেখিয়ে। বলাবাহুল্য, এক বিরাট পুলিশ-রাজ আত্মপ্রকাশ করেছিল সেইসময়। পাশাপাশি শুরু হয়েছিল শিল্প-সংস্কৃতির ওপর নিষেধাজ্ঞা ও অত্যাচার। তাই ১৯৭৫ সালে বহু নাট্যকর্মীর ওপর নৃশংস অত্যাচার নেমে এসেছিল। ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরে নাট্যকার অমল রায়ের ওপর একদল সশস্ত্র গুন্ডা আক্রমণ করেছিল এবং ১৯৭৬ সালের মার্চ মাসে শ্রী সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে পুলিশ খানাতল্লাশি চালিয়েছিল। ১৯৭৬ সালে বারাকপুরে নটতীর্থ ‘নিজবাসভূমে’ নাটকটি মঞ্চস্থ করার সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ এসে হাজির হয়েছিল। সাথেই জরুরি অবস্থায় চলচ্চিত্র জগতও প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ওমপ্রকাশের আঁধি, চেতন আনন্দের অফিসার ও সাহেব বাহাদুর, বি. এস. নাগির গোল্ডমেডেল রাজনৈতিক চক্রান্তের বলি হয়েছিল। মনোমোহন দেশাইয়ের ধরমবীর ও আর সিপ্পির শোলের রিলিজে বাধা এসেছিল। রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত গুলজারের মৌসম-এর বহু দৃশ্য অযৌক্তিকভাবে কাটা হয়েছিল। বহু সংলাপ সেন্সর হয়েছিল। অমরজিৎ পিকচার্সের ছবির নাম ছিল ‘ইন্দিরা’। গল্পের নায়িকার নামে ছবি। কোনো রাজনীতি ছিল না তবুও বাতিল করা হয়েছিল। তবে এই সবকিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল অমৃত নাহাতা প্রযোজিত ‘কিসসা কুরসিকা’। ঐ ছবিটির সার্টিফিকেট দেওয়ার জন্য ১৯৭৫ সালের ১৯ এপ্রিল ফিল্ম সেন্সর বোর্ডে দেওয়া হয়েছিল। ২৬ এপ্রিল সেন্সর বোর্ডের পরীক্ষক কমিটি ফিল্মটি পরীক্ষা করে দেখেছিলেন এবং সার্টিফিকেট দানে মতবিরোধ ঘটেছিল। শেষ পর্যন্ত ফিল্মটি আটক করা হয়েছিল এবং সঞ্জয় গান্ধির নির্দেশে পুড়িয়ে ফেলে প্রমাণ লোপাট করা হয়েছিল। ফলে নানাভাবে চলচ্চিত্র জগৎ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল। পাশাপাশি দূরদর্শনে চলতি ছবিগুলি দেখানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। নায়ক নায়িকাদের টি. ভিতে আসতে বাধ্য করা হয়েছিল। সেন্সরনীতি চালু করে প্রডিউসারদের শত্রু হয়ে শ্রী শুক্লা প্রথম শ্রেণীর নায়ক নায়িকা, পরিচালকদের গোলাম করে রাখতে চেয়েছিলেন। অঘোষিত আইন জারি হয়েছিল যেকোনো শিল্পীকে মেক আপ নিয়ে উপস্থিত হতে হবে। কিন্তু শিল্পীকে সই করতে হয়েছিল চুক্তিপত্রে। যারা বিরোধিতা করেছিলেন তাঁদের ছবি আর মুক্তি পাইনি।

শুধুমাত্র সংবাদপত্র, নাটক এবং চলচ্চিত্র ওপরেই সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করেই ক্ষান্ত হননি। এর পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের গান, কবিতা, উপন্যাস, ছোটোগল্প- এগুলিও সেন্সর করা হয়েছিল। মূলত, শঙ্খ ঘোষ, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গাঙ্গুলী, দীপক মজুমদার, মণীশ ঘটক, কমলেশ সেন, শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়, পান্নালাল মল্লিক, অঞ্জন কর, মণিভূষণ ভট্টাচার্য, দীপক মজুমদার, সুনীল গাঙ্গুলি, গৌরকিশোর ঘোষ, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, বিদ্যুৎবরণ চক্রবর্তী, শম্ভু রক্ষিত প্রমুখের কবিতা, সমর সেনের গদ্য, কৃষ্ণ চক্রবর্তী ও সুখরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস, উদয় রায়ের গল্প প্রভৃতির পাশাপাশি নজরুল ইসলাম ও রবীন্দ্রনাথের গান এবং কবিতার প্রচারেও সেন্সর আরোপ করা হয়েছিল। এমনকি, চলচ্চিত্রের এককালের বিশিষ্ট অভিনেতা ও জনপ্রিয় গায়ক কিশোর কুমারের হিন্দি ছবিতে কাজ করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, যুব কংগ্রেসের আয়োজিত দিল্লির সংগীত সন্ধ্যায় তিনি অংশগ্রহণ করেননি বলে তাঁর রেডিও প্রোগ্রামও বাতিল করা হয়েছিল।৬ এইভাবে ইন্দিরা গান্ধির নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস সরকার সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারটুকু সম্পূর্ণভাবে হরণ করেছিল।

                                                         – মহর্ষি সরকার, গবেষক ,বাংলা বিভাগ , যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় ।