জানেন কি? হিমালয়ের কোল ঘেঁষে রয়েছে দুর্যোধনের মন্দির, পুজো হয় আজও

306

দূর্বা দাসগুপ্তঃ  হিমালয়ের কোলে এক মুঠো রোদের আদর মেখে বসে থাকা ছোট্ট একটা গ্রাম।
হর কি দুন থেকে ফেরার পথে অনেক পথিকের একরাতের ঠিকানা এই গ্রাম। কিছু কিছু homestay আছে। আবার অনেকে গ্রামের বাইরে তাঁবু খাটিয়েও থাকে। আংটির গায়ে খোদাই করা মণির মতো পাহাড়ের গায়ে যেন খোদাই করে কোনো কারিগর সযত্নে এই গ্রামকে বসিয়ে দিয়ে গেছে।

জনসংখ্যা সাকুল্যে ছয়শ-সাতশো। সমতলের থেকে ৬৪৭ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত। ছোট ছোট কাঠের কুটিরে ঠাসা ঠাসি করে থাকা অভাবের, কিন্তু আনন্দের সংসার। কিছু কিছু কুটিরের গায়ে অসাধারণ গাড়োয়ালি কাঠের কাজ করা। সঙ্গে আছে পোষ্য ভেড়া, গরু ওর ছাগল। আর নেকড়ের মত দেখতে লোমশ বড় বড় সারমেয়। বসন্তের আবির্ভাবে যখন রাখাল ছেলে পশুদের উপত্যকায় চড়াতে নিয়ে যাবে, তখন এরাই তাদের পাহারাদার।

আমরা ওসলাএ ছিলাম অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে। শীত পড়তে আর এক মাস বাকি। তখন সব কিছু চলে যাবে বরফের সাদা চাদরের তলায়। তাই বাড়ি বাড়ি প্রস্তুতি চলছে শীতের বিরুদ্ধে ঘোষণা করা যুদ্ধের। প্রায় প্রত্যেক বাড়িরই সামনে অল্প বিস্তর জমিতে বরবটি জাতীয় সব্জি ফলে আছে। তার সাথে আছে ছাদে লতানো লাউ কুমড়ো। সেই বরবটির বীজ শুকনো করে রাখা, জ্বালানির কাঠ জোগাড় করা, গৃহপালিত পশুদের খাবারের ব্যবস্থা করা। সে এক বৃহৎ কর্মযজ্ঞ।হর কি দুনের পুরো রাস্তাতেই দেখা হয় পিঠে ঘাসের বস্তা নিয়ে নানা বয়েসের গ্রামবাসীদের সাথে। যতদিন ঘাস আছে, ততদিনের মধ্যে আসন্ন শীতের রসদ জোগাড় করে রাখতে হবে। আর দেখা হয় দেবশিশুর মত গ্রামীণ শিশুদের সাথে। তাদের পরনে ছেঁড়া জামাকাপড়। কিন্তু মুখের হাসিটা অমূল্য।

তবে ওসলা গ্রামে সব থেকে বিখ্যাত হল তার অতিপ্রাচীন শিউজির মন্দির। গঠন শৈলীতে কাঠমান্ডুর পশুপতিনাথ মন্দিরের মত। পুরোনো ভ্রমণ কাহিনীতে শোনা যায় এটা আসলে দুর্যোধনের মন্দির ছিল। জানা যায়, ওসলা, জাখোল, গাংগার এহং দাতমির গ্রামের বাসিন্দারা পুজো করেন দুর্যোধনের। দুর্যোধন শুধু এই এলাকার উপাস্য দেবতা নন, স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে তিনি এই কয়েকটি গ্রামের রক্ষাকর্তা। মূলত, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীমের হাতে দুর্যোধনের মৃত্যুর পর এখানকার স্থানীয় বাসিন্দারা কয়েক দিন ধরে কেঁদেছিলেন। তাঁদের চোখের জলেই নাকি তামস নদীর উত্‍পত্তি হয়। এরপর থেকে সেখানে পূজিত হন দুর্যোধন। পৌষ মাসের পঞ্চম দিনে ওসলা মন্দির থেকে দুর্যোধনের মূর্তিকে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার মাধ্যমে মোরি জেলার ফিতারি গ্রামে নিয়ে যান জাউনসার-বাওয়ার জেলার প্রধান ও ওসলা মন্দিরের প্রধান পূজারী। সেখান থেকে কোটেগাঁও, দাতমির ঘুরে ২০ দিন পরে ফের ওসলা মন্দিরে ফিরে আসেন ।

তবে প্রায় ৫০ কিমি ট্রেক করে শ্রান্ত হয়ে যখন এক গোধূলি বেলায় ওসলা পৌঁছাই, তখন ঘরে ঘরে উনুন জ্বলে উঠেছিল। শিশুরা খেলা ছেড়ে বাড়ি ফিরছে। বাড়ি ফিরছে ভেড়ার পাল নিয়ে রাখালছেলে। শিশুদের কলরবে, গৃহপালিত পশুর গলার ঘন্টির আওয়াজে, আর নিচ দিয়ে বয়ে চলা নদীর সংগীতে আচ্ছন্ন হয়ে আসছে চারিদিক। আর সামনে দিগন্ত বিস্তৃত আকাশে সূর্যর শেষ আলোয় রেঙে উঠছে স্বর্গারোহিনী।

স্থানীয় এক homestay তে রাত কাটিয়ে পরের দিন রওনা দিলাম তালুকার উদ্দেশ্যে। এবারের মত ট্রেকের পালা সাঙ্গ। কলকাতায় ফিরে কোনো এক জনঅরণ্যে আটকে পরা সন্ধ্যায় ঘামতে ঘামতে মনে পড়বে ওসলায় দেখা আকাশটার কথা। আর তখন আবার আরও একবার পিঠে rucksack নিয়ে বেরিয়ে যাব হিমালয়ের বুকে আরেকটা স্বর্গ খুঁজতে।।