ভারতে কেন বারবার লাইনচ্যুত হয়ে ‘রেল দুর্ঘটনা’ ঘটে? তদন্তে উঠে এল চাঞ্চল্যকর তথ্য

ভারতীয় রেল বিশ্বের বৃহত্তম ও ব্যস্ততম রেল পরিবহন ব্যবস্থাগুলির অন্যতম। প্রতিদিন ২ কোটির বেশি যাত্রী এবং ২০ লক্ষ টনেরও বেশি পণ্য ভারতীয় রেলপথে চলাচল করে। এই রেলপথ এক লাখ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত অর্থাৎ ৬২ হাজার মাইলেরও বেশি রেললাইন সারা দেশকে এক বিশাল নেটওয়ার্কে জুড়ে রেখেছে। ভারতের রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণবের মতে, গত বছর প্রায় ৫,২০০ কিলোমিটার নতুন ট্র্যাক স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়াও প্রতি বছর আট হাজার কিলোমিটার রেল লাইন আপগ্রেড করা হচ্ছে বলে তিনি জানান। এছাড়াও বেশিরভাগ রেললাইন আপগ্রেড করা হচ্ছে যেন এর ওপর ট্রেনগুলো ঘণ্টায় ১০০ থেকে ১৬০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারে। তবুও, ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া, দেশটির রেলওয়ে খাতের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটির রেলওয়ে বোর্ডের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, বিবেক সাহাই এমনটাই বলেছেন।

যদিও, ভারতে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া নিয়ে ২০২২ সালে দ্য কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল অব ইন্ডিয়া (ক্যাগ) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এতে ভারতের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিভিন্ন ত্রুটি থাকার তথ্য উঠে আসে। এই প্রতিবেদনে দুর্ঘটনা এড়াতে বেশ কিছু সুপারিশও করা হয়েছিল। গত শুক্রবার ওডিশায় ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনার পর ওই প্রতিবেদনটির প্রসঙ্গ আবারও সামনে এসেছে। ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত এক নিরীক্ষায় পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা বন্ধ করতে রেল মন্ত্রণালয়কে কী ধরনের ব্যবস্থা নিতে হবে, তা নির্ধারণের জন্য নিরীক্ষাটি চালানো হয়েছিল। এতে দেখা গেছে, ট্র্যাক রেকর্ডিং কার ব্যবহার করে রেললাইনগুলোর সক্ষমতা মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ থেকে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত ঘাটতি ছিল। এছাড়া দুর্ঘটনার জন্য আরও বেশ কিছু কারণকে চিহ্নিত করা হয়েছে।

১৬টি জোনাল রেলওয়েতে ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনায় ১ হাজার ১২৯টি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এসব দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ২৪টি বিষয় কাজ করেছে। এসব ক্ষেত্রে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৩২ দশমিক ৯৬ কোটি টাকা। রেলে লাইনচ্যুত হওয়ার সর্বমোট ৪২২টি ঘটনার জন্য প্রকৌশল বিভাগকে দায়ী করা হয়েছে। ১৭১টি দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে বড় কারণটি ‘রেললাইনের রক্ষণাবেক্ষণ’ সম্পর্কিত। অনুমোদিত সীমার বাইরে ট্র্যাক প্যারামিটারগুলোর বিচ্যুতির কারণে ঘটেছে ১৫৬টি ঘটনা। ১৮২টি ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনায় যন্ত্রকৌশল (মেকানিক্যাল) বিভাগকে এবং ১৫৪টি দুর্ঘটনার জন্য ট্রেনচালকদের দায়ী করা হয়। বাজে ভাবে ট্রেন চালানো, অতিরিক্ত গতিকেও অন্যতম কারণ বলে মনে করা হয়। পরিচালনা বিভাগের দায় পাওয়া গেছে ২৭৫টি ঘটনায়।

২০১৭ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ১ হাজার ১২৭টি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ২৮৯টি রেললাইন নবায়নের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ৬৩ শতাংশ দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে যথাসময়ে কর্তৃপক্ষের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়নি। আর ৪৯ শতাংশ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ প্রতিবেদন নিতে দেরি করেছে। এছাড়া রাষ্ট্রীয় রেল সংরক্ষা কোষ (আরআরএসকে) থেকে প্রায়োরিটি-১ প্রকল্পে খরচের পরিমাণ ক্রমাগত কমতে দেখা গেছে। ২০১৭-১৮ সালে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৮১ দশমিক ৫৫ শতাংশ, তা ২০১৯-২০ সালে কমে ৭৩ দশমিক ৭৬ শতাংশে দাঁড়ায়। যে অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছিল, তাও পুরোপুরি কাজে লাগানো যায়নি। নিরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে রেললাইনে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের সুপারিশ করে ক্যাগ। এ জন্য কঠোর পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা কার্যকরের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।

এদিকে এই দুর্ঘটনার পর বিবিসি, ভারতের সরকারি রেলওয়ে সেফটি রিপোর্ট ২০১৯-২০ এর তথ্যগুলো সামনে নিয়ে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতে রেল দুর্ঘটনার ৭০ শতাংশ ট্রেন লাইনচ্যুত হওয়া কারণে ঘটেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬৮ শতাংশ বেশি। এর পরের দুটি কারণ হচ্ছে, ট্রেনে অগ্নিকাণ্ড এবং সংঘর্ষ, যা যথাক্রমে মোট দুর্ঘটনার ১৪ শতাংশ এবং আট শতাংশ। প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই সময়ে লাইনচ্যুত হওয়া ৪০টি ট্রেনের মধ্যে ৩৩টি যাত্রীবাহী ট্রেন এবং সাতটি মালবাহী ট্রেন। এর মধ্যে ১৭টি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে রেললাইনে ত্রুটি থাকার কারণে, যার মধ্যে ফাটল এবং রেললাইনের সংকোচন-প্রশমন দুটি বড় কারণ। প্রতিবেদন অনুযায়ী ট্রেন-ইঞ্জিন, কোচ, ওয়াগনে ত্রুটির কারণে ৯টি লাইনচ্যুত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।