Netflix’s Ray Review: সাহিত্যিক সত্যজিত রায়কে বাংলার বাইরে কজন চেনেন?

144

স্বাতী ঝাঃ  সদ্য ওয়েব প্ল্যাটফর্ম নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে RAY। এবং এই ওয়েবসিরিজটি মুক্তি পাবার পরেই স্বাভাবিক ভাবেই দুটি দল গঠিত হয়েছে। একটি দল মুক্তকন্ঠে প্রশংসা করেছেন এই নতুন প্রচেষ্টার, অন্য দল তুলোধোনা করতে কোন ত্রুটি ছাড়েননি। এখানে যে জিনিসটা চোখে পড়ার মত তা হল স্পটলাইট ফিল্মটির শুরুতে রায়মশাইয়ের বিখ্যাত উক্তি- “There is always some room for improvisation.” সময়ের সাথে adaptation বা improvisation জরুরী তবে সে পরিবর্তন যেন মূল essence থেকে দূরে না সরে যায়। মনে রাখতে হবে improvisation আর alteration শব্দ দুটি কিন্তু এক নয়।

প্রথমেই ধরা যাক সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত Forget Me Not সিনেমার কথা, যেটি ‘বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম’ গল্পটি অনুসরণে তৈরী। সেই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র বিপিন চৌধুরীর সিনেমার ইপ্সিত নায়ারের মত কম্পিউটারাইজড ব্রেইন না হলেও কর্মক্ষেত্রে তিনিও একজন সফল ব্যক্তি। গল্পে তাঁর স্মৃতিভ্রম এবং তার ফলে মানসিক দোলাচল, তীব্র অস্বস্তি ভীষণ effective ভাবেই অসামান্য অভিনয়ের দ্বারা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এবার এই ঘটনার পেছনের অংশ যারা সিনেমা দেখেছেন এবং বইয়েও পড়েছেন তাঁরা বলবেন গল্পের সঙ্গে সঙ্গতি নেই। কিন্তু মনে রাখতে হবে ছোটগল্পের পরিসরে যা চলে, তা অনস্ক্রিন সবসময় ততটা প্রভাবশালী হয়না। গল্পে বিপিনবাবুর বাল্যবন্ধুর প্রতি দুর্ব্যবহার এবং তার ফলে সেই ছোট্ট প্রতিশোধকে পর্দায় এক অন্য মাত্রা দিতে সম্পর্কের ওঠাপড়া, বিশ্বাসঘাতকতার মত ইস্যু গুলি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ছিল। শেষে ইপ্সিতের দুরবস্থাও সেই কারণগুলিকেই justify করে। যাঁরা গল্পের সাথে মিল নেই বলে দাবী করছেন সেটিও পুরোপুরি ঠিক নয়। এখানেও বাল্যবন্ধুর অপমান একটি ইন্ধন হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।

দ্বিতীয় গল্প সৃজিত মুখার্জি পরিচালিত ‘Bahrupiyan’ যে ‘বহুরুপী’ গল্পটির উপরে তৈরী তা প্রথম থেকেই নামের মিলের জন্য বুঝতে কারোরই অসুবিধা হয়নি। এক্ষেত্রে অমিলটা শুরুতেই ছিল। গল্পের চরিত্র নিকুঞ্জ সাহার কাছে মেকআপটা ছিল শখ। নিত্যনতুন বেশধারণ করে পরিচিতদের সামনে গিয়েও কেউ তাঁকে চিনতে পারছেনা শুধুমাত্র এই আনন্দেই তিনি মেকআপের ব্যবহার করতেন। কিন্তু পর্দায় ইন্দ্রাশিস শাহ মেকআপকে গ্রহণ করে প্রতিদিনের অপমান, লাঞ্ছনা থেকে মুক্তির এক নতুন পথ হিসেবে। গল্পের শুরুতে কে.কে.মেনন তাঁর ছাপোষা লুকের মাধ্যমে এক দূর্বল ব্যক্তিত্বকে ভীষণ স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন যে সমাজের উপর প্রতিশোধ নিতে হাতে তুলে নিয়েছে তার অস্ত্র। অনেকেই এখানে অভিযোগ করছেন অতিরিক্ত adult content দিয়ে মার্কেটিংয়ের চেষ্টা করা হয়েছে কিন্তু আমার মনে হয় মূল চরিত্রের inferiority complex দেখানোর স্বার্থেই তার ব্যবহার। সে ভাবছে তার দূর্বল ব্যক্তিত্বের জন্য তার প্রেমিকা তাকে পাত্তা দিল না এবং সেই প্রতিশোধের আগুনেই তার এই রুপান্তর। তাই এখানে দেবশ্রী ও অন্যান্য নারী চরিত্রগুলিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। হয়তো এভাবে পরিচালক এই চরিত্রটি জাস্টিফাই করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আস্তে আস্তে শিল্পীর অহংকার মনুষ্যত্বকে গ্রাস করলে সে নিজেকে ঈশ্বরতুল্য মনে করে। এইখানে অদ্ভুত ভাবে সত্যজিত রায়ের আরেক ছোটগল্প ‘ভুতো’র কথা মনে পড়ে যায় যেখানে ভেন্ট্রিলোকুইস্ট নবীন খ্যাতির চরমে পৌঁছে অক্রূরী চৌধুরীর উপর প্রতিশোধস্পৃহায় ধরাকে সরা জ্ঞান করে। কিন্তু সে ভুলে যায় গুরুর গুরু আছে। যেমন এখানে ভুলেছে ইন্দ্রাশিস। গল্পের সাথে সম্পূর্ণ মিল রেখে এখানেও সন্ন্যাসীর অভিশাপে নিকুঞ্জ সাহার মত ইন্দ্রাশিষেরও মুখোশই মুখ হয়ে ওঠে। সে বুঝতে পারে সেই সর্বশক্তিমান নয়। তবে গল্পের থেকে এর শেষটা অনেকটা আলাদা। গল্পে নিকুঞ্জ তাঁর ভুল বুঝে নিজেকে শোধরানোর সুযোগ পেলেও ইন্দ্রাশিষের ক্ষেত্রে হয়তো তা ঘটেনি।

তৃতীয় ফিল্ম অভিষেক চৌবে পরিচালিত’Hungama Kyun Hain Barpa‘ বারীন ভৌমিকের ব্যারাম গল্পটির উপর আধারিত। এই সিনেমাটি আগের দুটোর Dark ending এর পর অনেকটাই comic relief এর কাজ করে। শুরুতেই আলোকোজ্জ্বল স্টেশনের হইহল্লা, দক্ষ অভিনেতা মনোজ বাজপেয়ীর হাল্কা মেজাজ, কিছু ঊর্দু শায়রি, ট্রেনের কামরার অপূর্ব সাজসজ্জা আগের সিনেমাদুটির প্রায়ান্ধকার পরিবেশের তুলনায় যেমন চোখকেও আরাম দেয় তেমনি এক অপূর্ব আমেজও গড়ে তোলে। আস্তে আস্তে গল্প যত এগোয় আমরা আমাদের সামনে ঠিক বারীন ভৌমিককেই যেন মূর্ত হয়ে উঠতে দেখি। বাংলায় এক বিখ্যাত প্রবাদ আছে ‘চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা যদি না পড়ো ধরা।’ কিন্তু চুরি করার পর চোর যদি আবার সেই পরিস্থিতিরই সম্মুখীন হয়? দশ বছর আগে চুরি করা ‘খুশবক্ত’ নামের ঘড়িটিও চোরের সাথে অর্থাৎ বামাল সমেত হাজির! প্রতি মুহূর্তে এই ধরা পড়ার ভয় যা গোটা গল্প জুড়ে ছিল তা এখানেও সমান ভাবে বিদ্যমান। তবে একটু অদ্ভুত লাগে যখন মুসাফির হাকিমের কাছে গিয়ে তার দোষ কবুল করলে তিনি জানান এই চুরি করার জন্য হাত নিশপিশ করা রোগটির নাম ক্লিপ্টোম্যানিয়া। প্রশ্ন হল একজন হাকিম বা আমরা চলতি কথায় যাকে হাতুড়ে ডাক্তার বলি তার পক্ষে এমন এক কঠিন মানসিক ব্যাধি সম্বন্ধে জানা কতটা সম্ভব! তবে আসল পরিবর্তন আসে শেষে যেখানে ‘Rooh safa’ নামের মোড়কে পরিচালক মনুষত্বের জয়গান গেয়ে বেশ সুন্দর পরিসমাপ্তি ঘটিয়েছেন। মানুষ ভুল করে, কিন্তু সেই ভুলকে শোধরানোর দায়ও মানুষেরই।

চতুর্থ গল্প ভাসান বালা পরিচালিত ‘Spotlight’ নামের গল্পের উপরেই তৈরী। এই গোটা সিরিজে সবচেয়ে বেশী আশাহত করেছে এটি। মূল গল্পে অংশুমান চ্যাটার্জী নামক এক ফিল্মস্টারের উপর থেকে স্পটলাইট সরে যায় একশো ছাব্বিশ বছর বয়সী এক বৃদ্ধের উপর। সিনেমার খাতিরে পরিচালক এখানে দীর্ঘায়ু ভদ্রলোকের জায়গায় এক দৈবীশক্তি সম্পন্ন ‘দিদি’ নামধারী চরিত্রকে এনেছেন। গল্প শুরু হয় এখানে ফিল্মস্টারের দৃষ্টিকোণ থেকে। যে তার চারপাশে পাগলের মত ফ্যানদের দেখতে অভ্যস্থ সে জায়গায় হঠাৎ একা হয়ে গেলে তা মেনে নিতে অসুবিধে তো হবেই যেমন এখানে হয়েছে ভিকের। তাই এই দিদিকে প্রতিদ্বন্দী ঠাউরে সে প্রমাণ করার চেষ্টা করে ‘I am the best’। কিন্তু এরপরেই মূল গল্পের আঁচ মাত্র না রেখে গল্পের গোরু গাছ থেকে আকাশে উড়তে শুরু করে। ভিকের সঙ্গে দিদির encounter এবং তার পরের ঘটনাবলী দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল পরিচালক ভদ্রলোক আসলে করতে কি চেয়েছিলেন! অভিনয়ের দিক থেকেও তেমন উচ্চমানের লাগলোনা এটিকে। প্রাপ্তি বলতে শেষের গানটি মন ছুঁয়ে যায়।

সবশেষে এটাই বলা যায়, এই প্রচেষ্টা বাহবা পাওয়ার উপযুক্ত। Netflix এর মত মাধ্যম যা সমগ্র ভারত জুড়ে অত্যন্ত বিখ্যাত সেই মাধ্যমে উপস্থাপন করতে হলে আপামর ভারতবাসীর মত করেই উপস্থাপিত করা উচিত। একথা ভুললে চলবেনা পরিচালক সত্যজিত রায় বিশ্ববন্দিত, কিন্তু সাহিত্যিক সত্যজিত রায়কে বাংলার বাইরে কজন চেনেন? ফেলুদা গল্পগুলি বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হলেও তাঁর ছোটগল্পগুলির রত্নভান্ডার এখনো লোকচক্ষুর আড়ালে। তাই সেই রত্নকে সর্বসমক্ষে আনতে হলে জহুরীর চোখ, সঠিক ছাঁদ এবং পালিশ সবই প্রয়োজন। তাই ‘Forget Me Not’ ছবিরই একটি লাইন একটু পরিবর্তিত করে বলি- So after Ray, because of Ray, RAY comes again with new ray.